পৃষ্ঠাসমূহ

Thursday, January 1, 2015

এক বিন্দু বেহেস্ত

: বাবা আমি রিফাতকে বিয়ে করবো।
: কি, কি বললে তুমি?
: আমি বলেছি আমি রিফাতকে বিয়ে করবো।
: তুমি কি আজকে পাগল হয়ে গেছ?
: হ্যা বাবা হয়েছি তবে রিফাতের প্রেমে।

: তুমি আমার মেয়ে হয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত কিভাবে নিলে আমি ভেবে অবাক হচ্ছি।
: তোমার মেয়ে বলেই তো আমি এমন একটি কঠিন সিদ্ধান্ত এত সহজে নিয়ে ফেলেছি।
: রিফাত কি করে, কি তার বংশ মর্যাদা, তার সামাজিক অবস্থানই বা কি সেসব কিছু না জেনে তোমার এমন আত্মহত্যা মূলক সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতে পারিনা।
: ওকে বাবা, তাহলে আমি ওকে পালিয়ে বিয়ে করবো। আমাকে খাওয়ানো পড়ানো এবং আমার এমএ পড়ানো সহ আমার পুরো দায়িত্ব রিফাত অনায়াসে নিতে পারবে।
: তার বাবা কি কোটিপতি?
: না বাবা, তার বাবা পরের জমিতে কামলা খেটে রিফাতকে এমএ পাশ করিয়েছে।
: তাহলে নিশ্চই রিফাত বড় কেন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে জব করে?
: না বাবা, সে বিভিন্ন মুদি দোকানে নানা ধরনের ব্যবহার্য পণ্য সাপ্লাই করে।
: মুদি দোকানে দাঁতের ব্রাশ, দাঁতের কালো মাজন বিক্রি করে হাহ হাহ হা, হাসালে তুমি। তোমার লালন পালনে আমি সারা জীবনে অগাধ টাকা খরচ করেছি এবং এখনও করছি।
: আমি সব কন্ট্রোল করে ফেলবো বাবা, খরচ কমিয়ে আনবো।
: গত মাসেই তোমাকে ২০১৫ মডেলের লেক্সাস গাড়ি কিনে দিলাম।
: বাবা আমি এবং রিফাত রিকশা ব্যবহার করবো। রিকশায় ঘুরতে ভিন্ন ধরনের মজা আছে বাবা।
: তুমি একটি মাসও ওই রিফাতের সাথে টিকবেনা, অভাব কি জিনিষ তুমি জানইনা। তুমি অল্প কিছু দিনের ভেতরেই আবার আমার কাছে ফেরত আসতে বাধ্য হবে।
: আমারও তাই মনে হচ্ছে বাবা। তবে দেখিনা কি হয়, জীবনটা একটু অন্যরকম হলে তো আর মন্দ না।
: ইটস ইওর চয়েস মাই বেবি। এন্ড আই প্রমিস, ভেরি সুন ইউল বি ব্যাক টু ইওর পাপা।
: লেটস মি হ্যান্ডেল ইট পাপা। লেট মি মেক মাই ওউন হ্যাভেন।

বিজনেস টাইকুন আফতাব হোসেন একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা লাগালেন তার মেয়ে সাবা এবং রিফাতের উপর। আজ পত্রিকার হেড লাইনে তার আদরের মেয়ে সাবার ছবি এসেছে। সাবা পুরো বাংলাদেশে মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অর্জন করেছে। পত্রিকার সাক্ষাৎকারে সাবা তার ভালো রেজাল্টের জন্য তার বাবা এবং স্বামী রিফাতের সহযোগীতার কথা বলেছে। দীর্ঘ দুই বছর পর তিনি স্থির করলেন এবার নিজ চোখে দেখা যাক তারা কেমন আছে।

রহমান সাহেব সকাল সকাল সাবার প্রিয় ক্যাডব্যারি চকলেটের একটা প্যাকেট হাতে মিরপুরের একটা তিনতলা বস্তি মত বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছেন। দামি সাফারি স্যুট গায়ে চতূর্দিকের ময়লা, নোংরা বাচ্চাদের হই হল্লোর আর দূর্গন্ধকে পাশ কাটিয়ে তিনি তিন তলার একটা দরজার সামনে থমকে দাড়ালেন। দরজার গায়ে বড় বড় করে তার মেয়ে সাবার হাতের লেখা "আওর হ্যাভেন"।

রহমান সাহেব একটু কাছে গিয়ে দরজা হালকা ধাক্কা দিতেই শুনলেন ভেতর থেকে কথার আওয়াজ আসছে...

সাবা : তুমি আর কবে চুল আচড়ানো শিখবে বলো দেখি? কাস্টমার তোমার মাথা দেখে বলবে কাক এই মাত্র বুঝি তোমার মাথায় একটা ডিম পেরে গেছে।

রিফাত : আরে না, সাত সকালে তোমার সাথে আমি ঝগড়া না করলে আমার দিনটাই পানসে পানসে লাগে।

সাবা : ইশ সাহেবের ঢং দেখে বাঁচিনা। এই শোন আজকে বিকেলে আমরা দুজন ঘুরতে যাবো।

রিফাত : কিন্তু মালের ডেলিভারি আমি না দিলে তে সমস্যা।

সাবা : অসুবিধা নেই আরেকদিন যাবো। আর শোন, রাতে কিন্ত তারাতারি বাসায় আসবে, আমরা দুজন একসাথে খাবো।

রিফাত : এক শর্তে আমি রাজি আছি।

সাবা : ওরে বাবারে, আমি তোমাকে ভাত খাইয়ে দিতে পারবো না। বুড়া বাবু কোথাকার।

রিফাত : বোঝেনা সে বোঝেনা।

সাবা : গান টান বাদ দিয়ে এবার যাও তারাতারি। নইলে মালের বিল আজকেও পাবেনা।

রিফাত : হ্যা হ্যা যাচ্ছি, আমাকে ভাগিয়ে দিতেই খুব ভালো লাগে না?

সাবা : অফিসটা তোমার শশুরের নয়, দেরি করলে আমার চাকরি ঘ্যাচাং করে কেটে দেবে। তুমি আসার সময় চাল নিয়ে এসো। আমি সন্ধার সময় মাছ আর সব্জি নিয়ে আসবো।

রহমান সাহেব সাবা আর রিফাতের তীব্র সুখ সহ্য করতে পারলেন না। তাদের বেহেস্তের সামনে থেকে যত তারাতারি সম্ভব চলে যেতে হবে। তাদের এই সুখ নস্ট করার কোন অধিকারই তার নেই। তিনি চকোলেটের প্যাকেটটা দরজার কাছে রেখে সেখান থেকে চলে আসলেন।

সাবা দরজা খুলতেই ক্যাডবেরির প্যাকেটটা তার চোখে পরে। সাবা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। তার বাবা নিশ্চই এখানে এসেছিল।

রহমান সাহেব গাড়িতে বসে স্তব্ধ হয়ে আছেন। কি আশ্চর্য ব্যপার, চোখে পানি কেন? তিনি মোটেই চোখের পানি আটকাতে পারছেননা। সাবা পুরোপুরি তার মত হয়েছে। কখনো হার মানতে রাজি নয়। আজ সাবা জিতে গেছে, তিনি হেরে গেছেন। তিনি টাকা দিয়ে যে বেহেস্তটা বানাতে পারেননি, সেটা সাবা ভালোবাসা দিয়ে বানিয়ে ফেলেছে। তিনি এখন হাসছেন মেয়ের জয়ে। কিছু কিছু হার জয়ের চাইতেও মধুর হয়।

তিনি নতুন কেনা অফিসের কর্মচারীদের বেতনের বইটা হাতে নিলেন। সেখানে ইক্সিকিউটিভ অফিসারের সাইনটার উপর তিনি পরম মমতায় হাত বুলালেন। কি সুন্দর করে বেতনের রশিদে তার মেয়ে সাইন করেছে "সাবা"। আরে আশ্চর্য ব্যপার, আবারও তার চোখে জ্বল আসছে কেন?
বাবারা কি এমনই হয়?

পুনশ্চ : গল্পটির ৮০% বাস্তব। বাকিটুকু ফ্লেভার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

বিজয় দিবস উপলক্ষে ছোট গল্প



ফারিহার ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে এক ফাকে দেখে নিল, সকাল আটটা বেজে গিয়েছে। পাশে মীরা আর মহিব ঘুমিয়ে আছে । মহিবের মুখ হা হয়ে আছে। এই লোকটা এখনো হা করে ঘুমায়। এতো বড় হা যে, একদলা মশা ঘর সংসার করে আরামে থাকতে পারবে। ফারিহা একবার সাড়া রাত জেগে দেখেছে, মহিব একবারের জন্যও মুখ বন্ধ করে না। মহিবকে জানানো দরকার ব্যাপারটা। ফারিহা চোখ বন্ধ করে আছে। চোখে সূর্যের আলো পড়েছে, চোখ খুলে রাখতে পারছে না।

মীরা ফারিহার একমাত্র মেয়ে। বয়স আগামী মাসের ১৬ তারিখে নয় বছর হবে। এবার ক্লাস টু তে পড়ালেখা করে। পড়ালেখায় সে জিনিয়াস। ক্লাসের ফার্স্ট স্টুডেন্ট। মীরার লেখা কবিতা দৈনিক পত্রিকায় ছাপিয়েছে। কবিতা লেখার বিষয়টিও নাটকীয় ছিল। মীরাদের ড্রাইভার জব্বার সাহেবের খাটে ছারপোকা দিয়ে ভর্তি ছিল। মীরার সাথে ড্রাইভারের ভালো সম্পর্ক। মীরাকে ড্রাইভার মাগো বলে ডাকে। তার মেয়ে নাকি মীরার মতো, কিন্তু কালো। মীরা ফর্সা। একদিন মীরার সাথে কথা বলতে বলতে জব্বার সাহেব বলল,

- মাগো, তোমার ঘরে কি ছারপোকা আছে?
- নাহ, কেন?
- আমার ঘরে ছারপোকার বাসা
- ওমা বলে কি!
- হ রে মা। রাত্রে ঘুমাইতে পারি না। কামড়াইয়া পাগল বানায় দেয়। মন চায় খাটে আগুন ধরায় দেই। জামা কাপড়ও ভরে গেছে। চারপাশে শুধু ছারপোকা আর ছারপোকা।
- ওমা কি ভয়ঙ্কর! এখন কি হবে?
- কি আর করার! আমি রাতে এখন গাড়িতে ঘুমাই।
- তোমার সমস্যা হয় না?
- না।
- ও আচ্ছা।

মীরার মাথায় ছারপোকা নিয়ে কবিতা চলে আসলো। সেই কবিতা পড়ে জব্বার সাহেব হোহ হোহ করে হাসতে হাসতে অস্থির। আশ্চর্যের বিষয় এর পরে আর ছারপোকা ঐ ঘরে ছিল না। ছারপোকা পালিয়েছে। জব্বার সাহেব, মীরাকে থ্যাংকু দিল।

ফারিহা মহিবকে ডাকছে। এই লোকটার ঘুম না যেনো অন্য কিছু। ঘুমালে মরা মানুষের মতো শক্ত হয়ে যায়। একেবারে পাথরের মতো শক্ত। ডেকে জাগানো যায় না। অনেক ধাক্কাধাক্কি চলে। এরকম ধাক্কাধাক্কি চলার পরে এক সময় ঘুম ভাঙে। আজকেও ব্যতিক্রম হল না। ঘুম থেকে উঠেছে। ফারিহা আর কোনো কথা বলল না। এখন একা একাই উঠে পরবে।

নিয়ম অনুযায়ী, মহিব মীরাকে ওঠাবে । ফারিহা রান্নাঘরে যাবে। মহিবের ফারিহাকে মেনে চলতে হয়। একজন গাইড উইমেন। কখন কি করতে হবে, কি করা যাবে না, সবই ফারিহার কথা মতো চলতে হয়। মহিবের কোনো বিরক্ত লাগে না, ওর অনেক ভালো লাগে। ফারিহার কথা মেনে চলার আরেকটি কারন হল, ডাক্তার। ডাক্তার মহিবকে ফারিহার কথা মতো চলতে বলেছে। মহিব মানসিক ভাবে অসুস্থ। হঠাৎ করে মাথা থেকে সব মেমরি মুছে যায়, কিছুক্ষণ পরে আবার ফিরে আসে। যতোক্ষন মেমরি থাকে না, ততোক্ষণ কিছুই মনে করতে পারে না। চুপ করে থাকে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তাকিয়ে থাকে।

মহিব মীরাকে নিয়ে খাবার টেবিলে বসলো। মহিব মীরাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে, অফিসে যাবে। মহিব অফিসে কোনো কাজ করে না, শুধু পত্রিকা পড়ে। অফিসের কাজ করে ম্যানেজার সাহেব। এটাও ডাক্তারের কথাতেই হয়। ডাক্তার অতিরিক্ত চাপ নিতে নিষেধ করেছেন। মহিব মীরা বের হয়ে গেলে ফারিহা একা বাসায় থাকে। একা একা বাসায় কিছু ভালো লাগে না। কিছুক্ষণ রবীন্দ্রসংগীত শোনে, বেশি ভালো না লাগলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই পড়ে।


(২)

ইদ্রিস সাহেব মোটাগায়ের মানুষ। সকালে রোদে বসে থাকেন। তার পাশে রহমান দাঁড়িয়ে থাকে। ইদ্রিস সাহেব পত্রিকা পড়েন। দেশের হাল চাল কেমন তা জানেন। আজকের খবরে তেমন কিছু নাই। খাগড়াছড়িতে পাকিস্তানি মিলিটারিদের অর্ধ শতাধিক মৃত্যু। গ্রামের মানুষ পিটিয়েই অর্ধেক মেরে ফেলেছে, একেবারে গণধোলাই। একপরে স্যান্ডেল চাটিয়েছে। মাথা কামিয়ে, গোসল করিয়ে গুলি করে মেরে পুতে ফেলেছে। খবরটা পড়ে ইদ্রিস সাহেব একটু হাসলেন। মানুষ এবার মারতে শিখেছে। এই বুদ্ধিটা যদি আগে হতো তাহলে এতো গুলো মানুষ মারা যেতো না। ইদ্রিস সাহেব রহমানকে বললেন,

টেলিফোন করব।

- কাকে টেলিফোন করবেন?

- ফারিহাকে।

ইদ্রিস সাহেব, টেলিফোন কানে ধরলেন,

- হ্যালো।
- কে বাবা?
- হ্যা।
- কি হয়েছে বলো
- কিছু না।
- তাহলে ফোন করেছ কেনো?
- তুই কি ব্যস্ত?
- হ্যা।
- কি করছিস?
- বলতে ইচ্ছা করছে না।
- মীরা কোথায়?
- স্কুলে।
- মহিব?
- অফিসে।
- এখন একটু সাবধানে থাকিস মা।
- কেনো?
- পত্রিকায় পড়লাম, ঢাকায় নাকি মিলিটারিরা গোপন অভিযানে নামবে। সামনে যাকে পাবে তাকেই মারবে ।
- তুমি ভুল যানো। মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া অন্য কাউকে ওরা মারে না। ওরা চায় দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মারতে। সাধারণ মানুষ তাহলে কিছুই করবে না। সাধারণ মানুষ কবুতরের মতো, ঘরের ভেতরেও থাকতে চায় বাহিরেও থাকতে চায় মুক্ত অবস্থায়। সাধারণ মানুষ যুদ্ধ পছন্দ করে না।

- তোর মাথায় এসব কে ঢুকিয়েছে?

- কেউ না।
- মহিব?
- হ্যা।
- আচ্ছা রাখছি। সাবধানে থাকিস
- আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তোমার বাসা ঢাকার মাঝখানে, তুমি সাবধানে থেকো।
- উপদেশের জন্য ধন্যবাদ
- বাবা আমি উপদেশ দিচ্ছি না।
- আমি রাখব
- আমি বই পড়ছিলাম।
- কি বই?
- বলা যাবে না। প্রেমের গল্প।
- ভালো থাকিস

ইদ্রিস সাহেব ফোন রেখে দিলেন। ফারিহা তার বড় মেয়ে। বেশী আদর দিয়ে মেয়েটা নষ্ট করে ফেলেছিলেন । কলেজের এক বখাটে ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। ইদ্রিস সাহেব জানার পরই মেয়েকে মহিবের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। প্রেম ফ্রেম তিনি সহ্য করতে পারেন না। ফারিহা তার উপড় একটু রাগ করে থাকে। সেই ছেলে এখনো বিয়ে করে নি, ফারিহাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালো বাসতে পারবে না। ইদ্রিস সাহেবের স্ত্রী পাঁচ বছর আগে মারা গিয়েছেন। তার ছোট মেয়ের নাম নাইমা। এবার ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।


(৩)

- হ্যালো মহিব ভাই
- কে বলছ?
- আমি নাইমা।
- হ্যা বলো।
- আপনার সাথে খুবই জরুরি একটা ব্যাপারে কথা বলার ছিল।
- বলে ফেলো
- একটু লজ্জা লাগছে
- তাহলে থাক বলতে হবে না। লজ্জা কমলে বলবে।
- আসলে হয়েছে কি, বাবার চ্যালামুন্ডা আছে না? তারা আমাকে একটা ছেলের সাথে ঘোরাফেরা করতে দেখে ফেলেছে। আমি খুব বিপদে আছি।
- ছেলেটা কে?
- ছেলেটা একজন কবি, আগামী বই মেলায় তার কবিতার বই বের হবে ।
- তোমার সাথে সম্পর্ক কি?
- আমি তাকে ভালোবাসি।
- সে বাসে?
- হ্যা খুব
- সমস্যা কোথায়?
- আপনি তো জানেন বাবা প্রেম ট্রেম পছন্দ করেন না।
- তোমরা কি পালাতে চাচ্ছো?
- হ্যা। কিন্তু কোথায় পালাব?
- সবচেয়ে ভালো হয় ইন্ডিয়ায় গেলে।
- আপনি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?
- চেষ্টা করব।
- আচ্ছা। ধন্যবাদ
- ইটস ওকে।

মহিব টেলিফোন নামিয়ে রাখল। মহিব ফারিহাকে ফোন করলো।

- হ্যালো
- বলো
- কি করছো?
- বই পড়ছি।
- কি বই?
- শরৎ বাবুর , দেবদাস।
- এই বই তো আগেও পড়েছো।
- হ্যা।
- একগল্প একবারের বেশী ভালো লাগে না।
- আমার লাগে। তোমার ভালো না লাগলে কি আমারও ভালো লাগবে না?
- না তা বললাম কখন! এটা যার যার ব্যক্তি ইচ্ছা। পারসোনাল চয়েজ
- কি জন্য ফোন দিয়েছো?
- ভালো লাগছে না।
- কথা বললে ভালো লাগবে?
- হ্যা।
- আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না।
- আচ্ছা তাহলে রাখছি।
- হ্যা রাখো।

ফারিহা ফোন নামিয়ে রাখল। মহিবের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মহিব জানে ফারিহা তাকে ভালোবাসে না। মহিবের নিজের কাছেও ব্যাপারটা খারাপ লাগে। মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। তিনি যে একেবারে খারাপ মানুষ তাও না। মহিব বিয়ের কথা মনে করার চেষ্টা করছে। বিয়ের দিন হঠাৎ মহিবের বাবার বন্ধু ইদ্রিস সাহেব তাদের বাসায় এসে হাজির। মহিবের মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কিসব কথা বলল, মহিব কিছুই বুঝতে পারল না। মহিবের মা মহিবকে তৈরি হতে বলল, মহিব তৈরি হয়ে ইদ্রিস সাহেবের সাথে বাসায় চলে এলো। সেখানে এসে দেখে লাল শাড়ি পড়া পুতুলের মতো একটা মেয়ে বসে আছে। মহিব কিছুই বুঝতে পারল না। পাশে পাঞ্জাবি গায়ে একজন মুরব্বী বসে আছে। মহিব কোনো বাধা দিল না। মেয়েটার সাথে এর আগে কখনো তার কথা হয় নি। বিয়ে করে বৌ সাথে নিয়ে বাসায় ফিরল । বাসর রাতে মহিব জিজ্ঞেস করল,

- আমি যতোটুকু বুঝতে পারছি তুমি কিছু বলতে চাচ্ছ।

ফারিহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

- আমি একটা ছেলেকে ভালো বাসি। বাবা আমাকে জোর করে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আমি ভেবে অবাক হচ্ছি , পুরুষ মানুষ এতো নির্লজ্জ হয় কিভাবে? বলা নেই কয়া নেই হুট করে আপনি আমাকে বিয়ে করে বসলেন? নাকি আমার রূপ দেখে জিহ্বার পানি আটকে রাখতে পারেন নি।

মহিব ফারিহার কথা শুনে থ খেয়ে বসল। মাথা ঝিম ধরে গেল, গলা শুকিয়ে গেল। কখনো কোনো মেয়ের সাথে কথা বলে নি।তাই বুক ধুকধুক করছে। মহিব কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল

- আপনি যা ভাবছেন আসলে সেরকম কিছু না। মহিবকে ফারিহা থামিয়ে দিল। বলল,

- কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না।

মহিব সারারাত জেগে কাঁটালো। আস্তে আস্তে ফারিহা শান্ত হতে চেষ্টা করলো। মহিব জানে, সেগুলো মহিবের মায়ের চাপে পরেই করেছে। সন্তানও নিয়েছে সে কারনে। ফারিহা তার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায় নি। মহিব ফারিহাকে ভালোবেসে ফেলেছে। মহিব মনে করে, মেয়েটা তার কাছে ঋণী। ফারিহা যার সাথে প্রেম করতো, মহিব তার সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছিল। অনেক কষ্টে খোজ পেয়েছিল । মহিব কে দেখে বলল,

- আপনাকে তো চিনলাম না।
- আমাকে চিনবেন না। আমি ফারিহার স্বামী ।

লোকটার চুল বড় বড়। গায়ের রং শ্যামল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বয়স ছাব্বিশ সাতাশ হবে। হেসে দিয়ে বলল,

- আসুন ভিতরে বসুন।

মহিব ভিতরে গিয়ে বসল।

- কেমন আছেন?
- জ্বি ভালো।
- ঠিক কি কারনে এসেছেন বুঝতে পারলাম না ।
- ফারিহাকে অনেক জিজ্ঞেস করেও আপনার ব্যাপারে কিছু জানতে পারি নি। জানেনই তো, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের একটু বারতি আগ্রহ থাকে।

- ঠিকানা কোথায় পেলেন?
- আমার শ্বশুর দিয়েছেন।
- ও। বসুন। পানি চড়াচ্ছি। চা খেয়ে যান। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। একা একাই থাকি।
- ফারিহাকে কি আপনি অনেক বেশি ভালোবাসতেন?
- একটু বেশীই। কেনো?
- ফারিহাও আপনাকে খুব ভালোবাসে।
- কিভাবে বুঝলেন ?
- আমি যদি ভুল না করি তাহলে আপনাদের মধ্যে কোনো সমস্যা হয়েছিল।
- হ্যা। আমাকে বলেছিল, ওর বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে। আমি দিই নি।
- দেননি কেনো?
- আমি বেকার ছাত্র ছিলাম । বেকার মানুষের সাথে বিয়ে দিবে কিনা সেটা নিয়ে সংষয়ে ছিলাম।
- আমার একটা মেয়ে হয়েছে।
- তাই নাকি? ভালো তো।
- আপনাকে একটা অনুরোধ করব রাখবেন?
- বলুন
- আপনার নাম টা যেনো কি?
- আবিদ।
- আমার মেয়ের একটা নাম রেখে দিন।
- নাম রেখে দিন মীরা।
- ধন্যবাদ, মীরা নামই রাখব।
- ওয়েলকাম।
- এটা রাখুন,
- এটা কি?
- আমার অফিসের ঠিকানা। সময় করে আসবেন।
- হ্যা আসব।

তিন বছর হয়ে গিয়েছে, আবিদ আসে নি। আর খবরও নেওয়া হয় নি। ফারিহা খুবই সুন্দরী মেয়ে , তার সাথে ফারিহাকে মানায় না। এ বয়সে মেয়েদের একটু ঘুরেফিরে বেড়ানোর সময়। মহিব এই কাজটি করতে পারে নি। তিনি ফারিহাকে কোনো আনন্দ দিতে পারেন নি। ফারিহা চুপ থাকতে পছন্দ করে। জ্ঞানী মেয়েরা চুপচাপ থাকে। ফারিহা অত্যন্ত জ্ঞানী মেয়ে।


(৪)

ইদ্রিস সাহেবের দাত পড়ে গিয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের দাত পড়া শুরু হয় । ইদ্রিস সাহেবের প্রথম দাত পড়ল। তার অসহ্য লাগছে। সামনের দাতটিই পড়েছে। তিনি হাসতে পারছেন না। নিজের অবস্থা দেখে নিজেরই হাসি পাচ্ছে। কথাও বলছেন না। কথা বললে, সামনের দাতে ফাকা দেখা যাচ্ছে। বাগানে চেয়ার পেতে বসে আছেন। তার সামনে মহিব বসে আছে। মহিব বলল,

-কেমন আছেন?

ইদ্রিস সাহেব রহমানের দিকে তাকালেন। রহমান হাতের খাতাটা এগিয়ে দিল। ইদ্রিস সাহেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে কলম বের করে খাতায় লিখলেন । খাতাটা মহিবের দিকে এগিয়ে দিলেন। মহিব ইতস্তত করে খাতাটি হাতে নিল। খাতায় লেখা

-ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

মহিব বলল, জ্বি ভালো আছি। আপনার কি শরীর খারাপ? কথা না বলে খাতায় লিখে দিলেন কেনো?

ইদ্রিস সাহেব রহমানের দিকে তাকালেন। রহমান বলল

- চাচার দাত পড়ে গেছে। সামনের টা পড়েছে। কথা বললে খারাপ দেখা যায়। তাই সামরিক কথা বন্ধ। খাতায় লিখে লিখে কথা হবে।

মহিব বলল, তাহলে তো বড় রকমের প্রবলেম। ডাক্তার কিছু বলেছে? এভাবে কথা না বললে তো মুখে গন্ধ হবে।

রহমান বলল- জ্বি। ডাক্তার বলেছে নকল দাত লাগায় দিবে।

মহিব বলল- তাহলে ঠিক আছে। তুমি এখন যাও। আঙ্কেলের সাথে আমার পারসোনাল কথা আছে।

ইদ্রিস সাহেব হাত ইসারা করে রহমানকে যেতে বললেন। রহমান চলে গেল।

মহিব বলল - খাতার দরকার নাই। আমি উল্টো দিকে ঘুরছি। আপনি কথা বলুন। আপনার দাত কেউ দেখবে না।

মহিব ঘুরল। ইদ্রিস সাহেব খেঁকানি দিয়ে বললেন,

- কি বলবে বলো

মহিব বলল,- নাইমার জন্য একটা ছেলে দেখেছি।

ইদ্রিস সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন
- নাইমাকে এখন বিয়ে দিব না।
- কাহিনী আছে।
- কি কাহিনী?
- একটা ছেলের প্রেমে হাবুডুবু দিচ্ছে ।
- বলো কি! তুমি জানলা কিভাবে?
- কেনো আপনি জানেন না?
- না। আমার কি জানার কথা ছিল?
- হ্যা। নাইমা তো এরকমই বলল
- ও তাহলে নাইমা বলেছে তোমাকে ?
- হ্যা।
- আর কি কি বলেছে?
- বলেছে, ইন্ডিয়া পালিয়ে যাবে সাহায্য চায়।
- তুমি কি হেল্প করতে চাও?
- আপনি যদি বলেন।
- ছেলে কি করে?
- সাইকেলরিক্সা ঠিক করে, গেরেজ। নিজের না, বাবার।

ইদ্রিস সাহেব খেঁকানি দিয়ে বললেন,
- ক্যানসিল। তোমার কাছে যে পাত্র আছে সে কি করে?
- ছাত্র। গরীব, সামনের বই মেলায় বই বের হতে পারে।
- বই বের হতে পারে! মানে বের হবে কিনা সন্দেহ?
- হ্যা।
- ছেলে কি সুন্দর?
- না। কালো। তবে ভালো।
- তুমি আর ফারিহা একটু খোজ খবর নিয়ে দেখো, যদি ছেলে ভালো হয় তাহলে বিয়ের ব্যবস্থা করো।

- জ্বি আচ্ছা। এবার মুখ বন্ধ করেন।



ফারিহা শুয়ে শুয়ে ভাবছে। কিছুদিন হল, ফারিহার মনে হচ্ছে, মহিবকে তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। মহিব তার সব কথা চুপচাপ মানতে থাকে। লোকটা ভালো তবে, একটু বোকা বোকা। সেদিন ফারিহা জিজ্ঞেস করলো,

- এখন যদি আপনি একটা "আলাদীন চেরাগ" হাতে পান তাহলে কি চাইবেন?

মহিব বলল - কিছুই না। দৈত্য টাকে ছেড়ে দেব। চেরাগ এর দৈত্যেরও তো একটা ইচ্ছা আছে। তাই বলতাম - তুমি তিনটা ইচ্ছা বল আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করব।

ফারিহা হেসে বলল, আপনাকে দিয়ে হবে। আপনি মজাই বোঝেন না।
মহিব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাকিয়ে রইল। মীরা ওর বাবার পাগল । বাবার মধ্যে কি আছে, তা ফারিহা খুঁজে পায় না। ফারিহার মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই কিছু আছে! ফারিহার খুব ইচ্ছা করছে, তার ইচ্ছা গুলো পূরণ করতে। ফারিহার ইচ্ছে করছে, মহিবের কাছে যেতে। কেনো ইচ্ছা করছে, জানে না। এবার যে প্রথম ইচ্ছা করছে তাও না। এর আগেও অনেকবার এরকম ইচ্ছা হয়েছে। কিন্তু যখনই মহিব সামনে আসে ফারিহা কিছু বলতে পারে না। দরজায় টোকা পড়লো। ফারিহা দরজা খুলল। দরজার বাহিরে নাইমা। দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকে পড়লো। সোফায় বসে বলল

- একটা খুশির খবর দেব। তুমি শুনলে খুশী হবা।

ফারিহা কিছু বলল না। নাইমার পাশে এসে বসল। নাইমা বলল

- আমার বিয়ে পাকাপাকি।
- কার সাথে?
- আমার প্রেমিকের সাথে
- মানে?
- মানে টানে নাই। বাবাই বিয়ে দিচ্ছেন।
- বাবা তোর প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছেন তোর?
- হ্যা। জানো কে বিয়ে ঠিক করে দিয়েছে?
- না ।
- মহিব ভাই।
- কে?
- মহিব ভাই।

ফারিহা অবাক হল। মহিব কে সে যেরকম মনে করেছিল তার কারন গুলো আস্তে আস্তে ভুল প্রমানিত হচ্ছে। মহিব ফারিহার মনে যায়গা তৈরি করছে। মহিব লোকটি সম্ভবত বেশী রকমের রহস্যের।


(৫)

ফারিহা খুবই ভয়ানক স্বপ্ন দেখল। খুবই ভয়ানক স্বপ্ন। ফারিহার ভয় হচ্ছে। স্বপ্নে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক তবে, বাস্তবে ভয় পাওয়া মারাক্তক ব্যাপার। ফারিহা বাস্তবেই ভয় পাচ্ছে। ফারিহা বিছানা থেকে উঠে ফ্রেস হলো। জানালার পাশে বসে ছিল, হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। ফারিহা ফোনটা কানে নিলো,

- জ্বি বলুন।

ওপাশ থেকে পুরুষের কন্ঠ বলল

- এটা কি মহিবের বাসা?

- হ্যা।

- আপনি মহিব সাহেবের কি হোন?

- আমি তার স্ত্রী।
- আপনার স্বামীর বুকে দুইটা গুলি লেগেছে। তার অবস্থা খুবই খারাপ। আপনি কি আসবেন?

ফারিহার বুক ধপ করে ফাকা হয়ে গেলো। মাথা ভারি হয়ে যাচ্ছে। কোনো রকমে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলো

- কোথায় আসতে হবে বলুন

- গুলশান হাসান হাসপাতাল।

- ঠিক আছে আমি আসছি।

ফারিহা পাশের ঘরে গেলো। মীরা খেলছিলো। মীরাকে সাথে নিয়ে ফারিহা হাসপাতালে চলে গেলো।

ইদ্রিস সাহেব বেশ চিন্তিত। তিনি ভয়ে আছেন । ডাক্তার বলেছে, দোয়া করতে থাকেন। আমরা চেষ্টা করছি।

জব্বার সাহেব মেঝেতে বসে আছেন। এরই মধ্যে তিনি তিনবার কান্না করেছেন। এখন চুপ করে বসে আছেন।এখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে।

নাইমা মীরাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মীরা চুপ হয়ে বসে আছে। সে কিছু বুঝতে পারছে না। একটু পর পর একজন ডাক্তার বের হচ্ছে আর নানু জিজ্ঞেস করছেন, অবস্থা কি অবস্থা কি? মা চুপ করে আছেন । একটু পরপর চোখের পানি পড়ছে। মার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নাইমা আন্টিও চুপ হয়ে বসে আছে। একজন লোককে বলতে শুনলো, মিলিটারি গুলি করেছে। লোকটার গায়ে রক্ত দিয়ে মাখামাখি। নানু জিজ্ঞেস করলেন, ওর গায়ে গুলি লাগবে কেনো? ও তো গাড়িতে ছিলো। লোকটি বলল সে জানে না। সে বাবাকে রাস্তায় পেয়েছে। পকেটে অফিসের কার্ড পেয়েছিলো। কার্ড থেকে নাম্বার দিয়ে হাসপাতাল থেকে কল করেছেন। নানু লোকটিকে ধন্যবাদ দিলো। লোকটি চলে গেলো। মীরা কিছু বুঝতে পারছে না। বাবার কি হয়েছে? মিলিটারিররা কেনো বাবাকে গুলি করলো কিছুই জানে না। মীরার বাবার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। সকালে বাবা মীরাকে একটি ধাধা জিজ্ঞেস করেছিলো। বাবা বলেছিলো বিকেলে জবাব দেবে। বাবা কখনোই উত্তর দিতে পারে না। মীরাকেই জবাব দিতে হয়। বাবা না পেরে বলে, ইস! আমি ভেবেছিলাম এটা হতে পারে। মীরা ভালো করে জানে বাবা মিথ্যে বলে। বাবা ধাধা পারে না। কিন্তু বাবা মিথ্যুক না। বাবা অনেক ভালো মানুষ।


ডাক্তার বের হলো। ডাক্তারের মুখে চিন্তা। ইদ্রিস সাহেব সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ডাক্তার বললো, প্রচুর রক্ত বের হয়েছে। গুলি লেগেছে, বুকে। পড়ে গিয়ে মাথা ফেটেছে। মাথা থেকে অনেক রক্ত পড়েছে। আপাতত, গুলি বের করা শেষ হয়েছে। রুগী ফারিহার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন। ফারিহা কে? ইদ্রিস সাহেব ফারিহাকে দেখিয়ে দিলেন।

ফারিহা মহিবের সামনে বসে আছে। মহিব বলল,

- মহাখালী থেকে ফুল কিনছিলাম। হঠাৎ লোকজনের চিৎকারের শব্দ শুনলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি লেগে গেলো। আর কিছু মনে নেই।

ফারিহা তাকিয়ে রইলো।

- আমি বাঁচবো না।

ফারিহা এর আগে কখনোই বলে নি যে মহিবকে সে ভালোবাসে। আজকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে। ফারিহা মহিবের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

- আই লাভ ইউ।

মহিব চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলো। ফারিহা বলল

- আই লাভ ইউ

ফারিহা আবারও বলল,

- আমি তোমাকে ভালোবাসি।

মহিব চোখ বন্ধ করে আবার চোখ খুলে তাকালো। ফারিহাকে বললো ,

- আমিও তোমাকে ভালো বাসি।

ফারিহার বুকে ঢেউ খেলে গেলো। মহিবের মাথায় ব্যান্ডেজ করা। ফারিহা মহিবের মুখে হাত দিলো। মহিব বলল, মীরাকে ডাকো। ফারিহা মীরাকে সাথে নিয়ে ঢুকলো। মহিব বলল,

- আমি তোমার ধাধার উত্তর বের করতে পারিনি।
- আমি জানি।
- উত্তর টা কি বলবে ?
- পরে বলল। তোমার কি হয়েছে বাবা?
- কিছু হয় নি। তোমাকে একটু দেখবো।
- আচ্ছা দেখো

ডাক্তার রুমে ঢুকলেন। ডাক্তার বললেন,, আপনারা এখন যান। রোগীকে একা থাকতে দিন। ফারিহা মীরাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো।


রাত আড়াইটা। মীরার ঘুম ভাঙল কান্নার শব্দে। মা কান্না করছে। সবাই খুব চিন্তিত। পাশে বাবা শুয়ে আছে। ডাক্তার সাহেব চিন্তিত। ডাক্তার নানুর দিকে তাকাচ্ছেন, বাবার হাত ধরে আছেন। মা কান্না করছে। মীরা ওর মাকে কখনো কান্না করতে দেখে নি। আজকে অনেক কান্না করছে । মীরা বাবার দিকে তাকালো। বাবা কি যেনো বলতে চাচ্ছেন, শোনা যাচ্ছে না। বাবার অনেক কষ্ট হচ্ছে। বাবা চোখ বন্ধ করছেন আবার চোখ খুলছেন। রহমান আঙ্কেল বাবার পায়ে হাত ঘসছেন। জব্বার আঙ্কেল চিন্তিত ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। মীরা কিছুই বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে! বাবা চোখ বন্ধ করেছে অনেকক্ষণ হলো। চোখ খুলছে না। ডাক্তার সাহেব হাত ছেড়ে দিলেন। নানু চোখে হাত দিলেন। নাইমা আন্টির চোখে পানি। মা চিৎকার দিলেন। মার চিৎকার শুনে মীরার ভয় হলো। ভয়ে মীরাও চিৎকার করে উঠলো।



বি.দ্র. পুরো গল্পটাই কল্পনার ফসল। আমি কল্পনা করেছি, যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে একটা মানুষকে ঘিরে কিছু স্বপ্ন তৈরি হওয়ার পরে সেই স্বপ্নে পানি ঢেলে দিলে কেমন হয়। এই মোতাবেক লিখেছি। লিখতে লিখতে চিন্তা করেছি, না লিখব না। কয়েকবার লেখা বন্ধ করে চা খেয়েছি, ঘুমিয়েছি। ভেবেছি, এরকম গল্প। মহিব, মীরা, ফারিহার মতো তিরিশ লক্ষ মানুষের গল্প কি আমরা জানি? আমরা কি জানতে পারব? যদি এরকম কোনো ঘটনা ঘটে থাকে আমাদের কি তা জানার উপায় আছে? না নেই। আমার লেখার হাত ভালো না। লেখায় অনেক ভুল করেছি। কিছু বিরক্তিকর বিষয় তুলে ধরেছি। বোঝাই যাচ্ছে, আমি ব্যর্থ। শেষ পর্যন্ত না পড়ে অনেকেই চলে গিয়েছেন । তবে আমি চেষ্টা করেছি। তিরিশ লক্ষ গল্পের একটা গল্প তুলে ধরেছি । যার কোনো দলিল নেই। সত্যি হতেও পারে, নাও হতে পারে। সাজানো জীবনকে দুঃক্ষময় করার জন্য এসব গল্প অভিশাপ হয়ে থাকুক পাকিস্তানী জানোয়ারদের জন্য । যারা তিরিশ লক্ষ মানুষের সাদা জীবনে রঙিন কালো একে দিয়েছে।


শুভ্র আহমেদ

লাশকাটা ঘর, একটি মেয়ে ও হরিশচন্দ্র


লাশটা অনেক ক্ষণ ধরে মর্গের বারান্দায় পরে আছে। বেওয়ারিশ লাশ। একটি চাটাই দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে। লাশটির পা দুটো বের হয়ে আছে।

ডোম হরিশচন্দ্র বারান্দার এক কোনায় বসে গাঁজা টানছে। তার চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। হরিশ লাশের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ধবধবে ফর্সা দুটো পা। পা দুটো দেখে মনে হচ্ছে লাশটি কোন মেয়ের। হরিশ পায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে থাকিয়ে আছে। গাঁজার প্রভাবে সে এক রঙিন ভুবনে বিচরণ করছে।
যে দুজন পুলিশ লাশটি নিয়ে এসেছে, তাদের কোন খোঁজ নেই। লাশ পচতে শুরু করেছে। লাশ থেকে বের হওয়া দুর্গন্ধ ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে।

রাত প্রায় দশটা বাজে। হরিশ মর্গের বারান্দায় নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। দশটার দিকে দায়িত্বরত ডাক্তার এলেন। তিনি হরিশকে লাশ ব্যবচ্ছেদ করার নির্দেশ দিয়ে চলে গেলেন।
হরিশ আড়মোড়া ভেঙ্গে চারদিকে ভালো থাকাল। শুধু বারান্দার বাতিটা জ্বলছে। বাতিটা ঘিরে অসংখ্য পোকা উড়ছে।

পচা লাশের তীব্র গন্ধ এসে হরিশের নাকে লাগলো। হরিশ তার পকেট থেকে দিশি মদের বোতলটা বের করে এক চুমুক খেলো।
দরজা খুলে সে রুমের ভেতরের সবগুলো বাতি জ্বালাল। লাশ কাটার টেবিলটা ঠিক করে সে লাশটার কাছে আসলো। হরিশ লাশটা আস্তে করে তুলে টেবিলটার উপর রাখল। সে ধীরে রশির বাধন গুলো খুলে চাটাই টা সরাল।

পচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সী একটি মেয়ের লাশ। হরিশ লাশটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার জীবনে সে এতো সুন্দর মেয়ে দেখেনি। মেয়েটির মুখে অল্প একটু হাসি লেগে আছে। দেখে মনে হয় সে মৃত্যুতে অনেক আনন্দ পেয়েছে।

এতো সুন্দর একটি মেয়ে একটু পরেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। হরিশ লাশটার শরীর থেকে কাপড়গুলো সরিয়ে নেয়। পেটের কাছে আঘাতের ছিন্ন। হরিশ ছুরি দিয়ে পেট বরাবর একটি লম্বা টান দেয়। পেটটা দু ভাগ হয়ে যায়। এই সময় আঃ বলে লাশটি প্রচণ্ড ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে। হরিশ এক লাফে দূরে সরে যায়।

সে অনেক লাশ কেটেছে, কিন্তু কোনদিন এত ভয় পায়নি। হরিশ লাশটার দিকে তাকায়। লাশটা স্থির হয়ে জায়গায় পড়ে আছে, কিন্তু হাত দুটো পেটের কাটা জায়গাটা চেপে ধরে আছে। হরিশ মদের বোতলটা বের করে পুরো বোতলটা শেষ করে দেয়। মদের প্রভাবে তার ভয় অনেকটা দূর হয়ে যায়। সে আবার লাশটার কাছে যায়। হরিশ লাশের হাত দুটো সরিয়ে আবার ছুরিটা হাতে নেয়। এই সময় লাশটা ধীরে ধীরে উঠে বসে। ভয়ে হরিশের নেশার প্রভাব ছুটে যায়। মেয়েটা টেবিল থেকে নেমে কাপড়গুলো পড়ে নেয়।

ভয়ে হরিশের কণ্ঠ শুকিয়ে আসছে। হরিশ আস্তে আস্তে পেছনে সরে আসতে লাগলো। মেয়েটাও তার দিকে আসছে। খোলা চুল আর মোহময় দৃষ্টিতে সে হরিশের দিকে এগিয়ে আসছে। হরিশের পা দুটো ভারী হয়ে আসছে। মেয়েটা এসে হরিশের হাত ধরল। হরিশ আর সহ্য করতে পারলো না, মূর্ছা গেলো।
চোখে জলের ঝাপটা লাগছে। হরিশ ধীরে ধীরে চোখ খুলল। হরিশ দেখল তার পাশে মেয়েটি বসে আছে। হরিশের চিন্তা ভাবনা লোপ পেয়ে গেছে। সে এখন আর কিছু চিন্তা করতে পারছেনা।

"আপনার নামটা কি জানতে পারি?" মেয়েটি জিজ্ঞাসা করলো।
হরিশকে এই পর্যন্ত কেউ আপনি করে বলেনি। সবাই তাকে তুই করেই সম্বোধন করে।
"হরিশ"
"আমি নীরা।"
"ওহ"
"আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?"
হরিশ মাথা নাড়ল। তা হ্যা না না বুঝাল তা বোধগম্য হলনা।
"দেখুন তো কতটুকু কেটে ফেলছেন। আপনার কাছে সেলাই করার ব্যাবস্থা নেই?"
"আছে।"
"তাহলে সেলাই করে দিন।"
হরিশ পেটের কাটা অংশটুকু সেলাই করে দেয়। মেয়েটা হরিশের সাথে অনবরত কথা বলে যেতে থাকে।
"জীবনানন্দের ঐ কবিতাটা পরেছেন, কি যেন লাশকাটা ঘরে।"
"উনি কে?"
"আপনি জীবনানন্দ দাশকে চেনেন না। ঠিক আছে আমি কবিতাটা আপনাকে আবৃত্তি করে শুনাচ্ছি।"
নীরা গম্ভীর কণ্ঠে আবৃত্তি করে,
"যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।
বধূ শুয়ে ছিল পাশে - শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল,আশা ছিল-জোৎসনায়,-
তবে সে দেখিল কোন ভূত?
ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল -
লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।"

হরিশ কবিতা শুনে। হঠাৎ কেন জানি তার মেয়েটিকে অনেক ভালো লেগে যায়। তার মন থেকে সব ভয় দূর হয়ে যায়। তার মনেই থাকেনা সে একটি লাশের সামনে বসে আছে।

বাইরে চাঁদ উঠেছে। মধ্যরাতের নিশুতি পাখিরা জেগে উঠেছে। থেমে থেমে ডেকে উঠছে পাখিগুলো।
হরিশের মেয়েটির সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করে। তার জীবনের গল্প। লাশের সাথে তার বসবাসের গল্প।
মেয়েটি কথা বলতেই আছে। হরিশ মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনে। মেয়েটি রুমের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেটে যায়। সে গুনগুন করে গান গায়। হরিশ শুনতে থাকে। অদ্ভুত ভালো লাগায় তার মন ভরে যায়।

রাত গভীর হচ্ছে। মেয়েটি দ্রুত গতিতে রুমের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেটে যায়। তার হাটার গতি দ্রুততর হতে থাকে। মনে হয় যেন দৌড়াচ্ছে। মেয়েটি একসময় বসে পরে। করুন সুরে বিলাপ করতে থাকে। হরিশের মনে আবার ভয়টা ফিরে আসলো। সে দৌড়ে দরজার কাছে যায়। কিন্তু তার আগেই মেয়েটি দরজার নিকটে চলে আসে। হরিশ আতংকে নীল হয়ে যায়।

পরেরদিন সকালে ডাক্তার এসে অনেকক্ষণ ধরে হরিশকে ডাকল। কিন্তু তার খোঁজ পাওয়া গেলনা। মর্গের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেকক্ষণ ডেকে সাড়া না পেয়ে অবশেষে দরজা ভাঙ্গা হয়। লাশকাটার টেবিলে হরিশ শুয়ে আছে। তার পেটের মাঝ বরাবর দু ভাগ হয়ে আছে। ঠিক পাশেই পরে আছে রক্তমাখা ছুরিটা। রুমের ভেতর সেই লাশটি পাওয়া গেলনা।