অদ্ভূত কিছু নিয়ম অদ্ভুত কিছু জীবন তবুও নতুন এক জীবন্ত সুরে দুঃখ থেকে বহুদূরে অতৃপ্ত স্বত্তা খুঁজে ফেরে সকল উন্মাদনা ছেড়ে ছেড়ে
Thursday, January 1, 2015
বিজয় দিবস উপলক্ষে ছোট গল্প
ফারিহার ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে এক ফাকে দেখে নিল, সকাল আটটা বেজে গিয়েছে। পাশে মীরা আর মহিব ঘুমিয়ে আছে । মহিবের মুখ হা হয়ে আছে। এই লোকটা এখনো হা করে ঘুমায়। এতো বড় হা যে, একদলা মশা ঘর সংসার করে আরামে থাকতে পারবে। ফারিহা একবার সাড়া রাত জেগে দেখেছে, মহিব একবারের জন্যও মুখ বন্ধ করে না। মহিবকে জানানো দরকার ব্যাপারটা। ফারিহা চোখ বন্ধ করে আছে। চোখে সূর্যের আলো পড়েছে, চোখ খুলে রাখতে পারছে না।
মীরা ফারিহার একমাত্র মেয়ে। বয়স আগামী মাসের ১৬ তারিখে নয় বছর হবে। এবার ক্লাস টু তে পড়ালেখা করে। পড়ালেখায় সে জিনিয়াস। ক্লাসের ফার্স্ট স্টুডেন্ট। মীরার লেখা কবিতা দৈনিক পত্রিকায় ছাপিয়েছে। কবিতা লেখার বিষয়টিও নাটকীয় ছিল। মীরাদের ড্রাইভার জব্বার সাহেবের খাটে ছারপোকা দিয়ে ভর্তি ছিল। মীরার সাথে ড্রাইভারের ভালো সম্পর্ক। মীরাকে ড্রাইভার মাগো বলে ডাকে। তার মেয়ে নাকি মীরার মতো, কিন্তু কালো। মীরা ফর্সা। একদিন মীরার সাথে কথা বলতে বলতে জব্বার সাহেব বলল,
- মাগো, তোমার ঘরে কি ছারপোকা আছে?
- নাহ, কেন?
- আমার ঘরে ছারপোকার বাসা
- ওমা বলে কি!
- হ রে মা। রাত্রে ঘুমাইতে পারি না। কামড়াইয়া পাগল বানায় দেয়। মন চায় খাটে আগুন ধরায় দেই। জামা কাপড়ও ভরে গেছে। চারপাশে শুধু ছারপোকা আর ছারপোকা।
- ওমা কি ভয়ঙ্কর! এখন কি হবে?
- কি আর করার! আমি রাতে এখন গাড়িতে ঘুমাই।
- তোমার সমস্যা হয় না?
- না।
- ও আচ্ছা।
মীরার মাথায় ছারপোকা নিয়ে কবিতা চলে আসলো। সেই কবিতা পড়ে জব্বার সাহেব হোহ হোহ করে হাসতে হাসতে অস্থির। আশ্চর্যের বিষয় এর পরে আর ছারপোকা ঐ ঘরে ছিল না। ছারপোকা পালিয়েছে। জব্বার সাহেব, মীরাকে থ্যাংকু দিল।
ফারিহা মহিবকে ডাকছে। এই লোকটার ঘুম না যেনো অন্য কিছু। ঘুমালে মরা মানুষের মতো শক্ত হয়ে যায়। একেবারে পাথরের মতো শক্ত। ডেকে জাগানো যায় না। অনেক ধাক্কাধাক্কি চলে। এরকম ধাক্কাধাক্কি চলার পরে এক সময় ঘুম ভাঙে। আজকেও ব্যতিক্রম হল না। ঘুম থেকে উঠেছে। ফারিহা আর কোনো কথা বলল না। এখন একা একাই উঠে পরবে।
নিয়ম অনুযায়ী, মহিব মীরাকে ওঠাবে । ফারিহা রান্নাঘরে যাবে। মহিবের ফারিহাকে মেনে চলতে হয়। একজন গাইড উইমেন। কখন কি করতে হবে, কি করা যাবে না, সবই ফারিহার কথা মতো চলতে হয়। মহিবের কোনো বিরক্ত লাগে না, ওর অনেক ভালো লাগে। ফারিহার কথা মেনে চলার আরেকটি কারন হল, ডাক্তার। ডাক্তার মহিবকে ফারিহার কথা মতো চলতে বলেছে। মহিব মানসিক ভাবে অসুস্থ। হঠাৎ করে মাথা থেকে সব মেমরি মুছে যায়, কিছুক্ষণ পরে আবার ফিরে আসে। যতোক্ষন মেমরি থাকে না, ততোক্ষণ কিছুই মনে করতে পারে না। চুপ করে থাকে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তাকিয়ে থাকে।
মহিব মীরাকে নিয়ে খাবার টেবিলে বসলো। মহিব মীরাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে, অফিসে যাবে। মহিব অফিসে কোনো কাজ করে না, শুধু পত্রিকা পড়ে। অফিসের কাজ করে ম্যানেজার সাহেব। এটাও ডাক্তারের কথাতেই হয়। ডাক্তার অতিরিক্ত চাপ নিতে নিষেধ করেছেন। মহিব মীরা বের হয়ে গেলে ফারিহা একা বাসায় থাকে। একা একা বাসায় কিছু ভালো লাগে না। কিছুক্ষণ রবীন্দ্রসংগীত শোনে, বেশি ভালো না লাগলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই পড়ে।
(২)
ইদ্রিস সাহেব মোটাগায়ের মানুষ। সকালে রোদে বসে থাকেন। তার পাশে রহমান দাঁড়িয়ে থাকে। ইদ্রিস সাহেব পত্রিকা পড়েন। দেশের হাল চাল কেমন তা জানেন। আজকের খবরে তেমন কিছু নাই। খাগড়াছড়িতে পাকিস্তানি মিলিটারিদের অর্ধ শতাধিক মৃত্যু। গ্রামের মানুষ পিটিয়েই অর্ধেক মেরে ফেলেছে, একেবারে গণধোলাই। একপরে স্যান্ডেল চাটিয়েছে। মাথা কামিয়ে, গোসল করিয়ে গুলি করে মেরে পুতে ফেলেছে। খবরটা পড়ে ইদ্রিস সাহেব একটু হাসলেন। মানুষ এবার মারতে শিখেছে। এই বুদ্ধিটা যদি আগে হতো তাহলে এতো গুলো মানুষ মারা যেতো না। ইদ্রিস সাহেব রহমানকে বললেন,
টেলিফোন করব।
- কাকে টেলিফোন করবেন?
- ফারিহাকে।
ইদ্রিস সাহেব, টেলিফোন কানে ধরলেন,
- হ্যালো।
- কে বাবা?
- হ্যা।
- কি হয়েছে বলো
- কিছু না।
- তাহলে ফোন করেছ কেনো?
- তুই কি ব্যস্ত?
- হ্যা।
- কি করছিস?
- বলতে ইচ্ছা করছে না।
- মীরা কোথায়?
- স্কুলে।
- মহিব?
- অফিসে।
- এখন একটু সাবধানে থাকিস মা।
- কেনো?
- পত্রিকায় পড়লাম, ঢাকায় নাকি মিলিটারিরা গোপন অভিযানে নামবে। সামনে যাকে পাবে তাকেই মারবে ।
- তুমি ভুল যানো। মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া অন্য কাউকে ওরা মারে না। ওরা চায় দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মারতে। সাধারণ মানুষ তাহলে কিছুই করবে না। সাধারণ মানুষ কবুতরের মতো, ঘরের ভেতরেও থাকতে চায় বাহিরেও থাকতে চায় মুক্ত অবস্থায়। সাধারণ মানুষ যুদ্ধ পছন্দ করে না।
- তোর মাথায় এসব কে ঢুকিয়েছে?
- কেউ না।
- মহিব?
- হ্যা।
- আচ্ছা রাখছি। সাবধানে থাকিস
- আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তোমার বাসা ঢাকার মাঝখানে, তুমি সাবধানে থেকো।
- উপদেশের জন্য ধন্যবাদ
- বাবা আমি উপদেশ দিচ্ছি না।
- আমি রাখব
- আমি বই পড়ছিলাম।
- কি বই?
- বলা যাবে না। প্রেমের গল্প।
- ভালো থাকিস
ইদ্রিস সাহেব ফোন রেখে দিলেন। ফারিহা তার বড় মেয়ে। বেশী আদর দিয়ে মেয়েটা নষ্ট করে ফেলেছিলেন । কলেজের এক বখাটে ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। ইদ্রিস সাহেব জানার পরই মেয়েকে মহিবের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। প্রেম ফ্রেম তিনি সহ্য করতে পারেন না। ফারিহা তার উপড় একটু রাগ করে থাকে। সেই ছেলে এখনো বিয়ে করে নি, ফারিহাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালো বাসতে পারবে না। ইদ্রিস সাহেবের স্ত্রী পাঁচ বছর আগে মারা গিয়েছেন। তার ছোট মেয়ের নাম নাইমা। এবার ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।
(৩)
- হ্যালো মহিব ভাই
- কে বলছ?
- আমি নাইমা।
- হ্যা বলো।
- আপনার সাথে খুবই জরুরি একটা ব্যাপারে কথা বলার ছিল।
- বলে ফেলো
- একটু লজ্জা লাগছে
- তাহলে থাক বলতে হবে না। লজ্জা কমলে বলবে।
- আসলে হয়েছে কি, বাবার চ্যালামুন্ডা আছে না? তারা আমাকে একটা ছেলের সাথে ঘোরাফেরা করতে দেখে ফেলেছে। আমি খুব বিপদে আছি।
- ছেলেটা কে?
- ছেলেটা একজন কবি, আগামী বই মেলায় তার কবিতার বই বের হবে ।
- তোমার সাথে সম্পর্ক কি?
- আমি তাকে ভালোবাসি।
- সে বাসে?
- হ্যা খুব
- সমস্যা কোথায়?
- আপনি তো জানেন বাবা প্রেম ট্রেম পছন্দ করেন না।
- তোমরা কি পালাতে চাচ্ছো?
- হ্যা। কিন্তু কোথায় পালাব?
- সবচেয়ে ভালো হয় ইন্ডিয়ায় গেলে।
- আপনি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?
- চেষ্টা করব।
- আচ্ছা। ধন্যবাদ
- ইটস ওকে।
মহিব টেলিফোন নামিয়ে রাখল। মহিব ফারিহাকে ফোন করলো।
- হ্যালো
- বলো
- কি করছো?
- বই পড়ছি।
- কি বই?
- শরৎ বাবুর , দেবদাস।
- এই বই তো আগেও পড়েছো।
- হ্যা।
- একগল্প একবারের বেশী ভালো লাগে না।
- আমার লাগে। তোমার ভালো না লাগলে কি আমারও ভালো লাগবে না?
- না তা বললাম কখন! এটা যার যার ব্যক্তি ইচ্ছা। পারসোনাল চয়েজ
- কি জন্য ফোন দিয়েছো?
- ভালো লাগছে না।
- কথা বললে ভালো লাগবে?
- হ্যা।
- আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না।
- আচ্ছা তাহলে রাখছি।
- হ্যা রাখো।
ফারিহা ফোন নামিয়ে রাখল। মহিবের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মহিব জানে ফারিহা তাকে ভালোবাসে না। মহিবের নিজের কাছেও ব্যাপারটা খারাপ লাগে। মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। তিনি যে একেবারে খারাপ মানুষ তাও না। মহিব বিয়ের কথা মনে করার চেষ্টা করছে। বিয়ের দিন হঠাৎ মহিবের বাবার বন্ধু ইদ্রিস সাহেব তাদের বাসায় এসে হাজির। মহিবের মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কিসব কথা বলল, মহিব কিছুই বুঝতে পারল না। মহিবের মা মহিবকে তৈরি হতে বলল, মহিব তৈরি হয়ে ইদ্রিস সাহেবের সাথে বাসায় চলে এলো। সেখানে এসে দেখে লাল শাড়ি পড়া পুতুলের মতো একটা মেয়ে বসে আছে। মহিব কিছুই বুঝতে পারল না। পাশে পাঞ্জাবি গায়ে একজন মুরব্বী বসে আছে। মহিব কোনো বাধা দিল না। মেয়েটার সাথে এর আগে কখনো তার কথা হয় নি। বিয়ে করে বৌ সাথে নিয়ে বাসায় ফিরল । বাসর রাতে মহিব জিজ্ঞেস করল,
- আমি যতোটুকু বুঝতে পারছি তুমি কিছু বলতে চাচ্ছ।
ফারিহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
- আমি একটা ছেলেকে ভালো বাসি। বাবা আমাকে জোর করে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আমি ভেবে অবাক হচ্ছি , পুরুষ মানুষ এতো নির্লজ্জ হয় কিভাবে? বলা নেই কয়া নেই হুট করে আপনি আমাকে বিয়ে করে বসলেন? নাকি আমার রূপ দেখে জিহ্বার পানি আটকে রাখতে পারেন নি।
মহিব ফারিহার কথা শুনে থ খেয়ে বসল। মাথা ঝিম ধরে গেল, গলা শুকিয়ে গেল। কখনো কোনো মেয়ের সাথে কথা বলে নি।তাই বুক ধুকধুক করছে। মহিব কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
- আপনি যা ভাবছেন আসলে সেরকম কিছু না। মহিবকে ফারিহা থামিয়ে দিল। বলল,
- কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না।
মহিব সারারাত জেগে কাঁটালো। আস্তে আস্তে ফারিহা শান্ত হতে চেষ্টা করলো। মহিব জানে, সেগুলো মহিবের মায়ের চাপে পরেই করেছে। সন্তানও নিয়েছে সে কারনে। ফারিহা তার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায় নি। মহিব ফারিহাকে ভালোবেসে ফেলেছে। মহিব মনে করে, মেয়েটা তার কাছে ঋণী। ফারিহা যার সাথে প্রেম করতো, মহিব তার সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছিল। অনেক কষ্টে খোজ পেয়েছিল । মহিব কে দেখে বলল,
- আপনাকে তো চিনলাম না।
- আমাকে চিনবেন না। আমি ফারিহার স্বামী ।
লোকটার চুল বড় বড়। গায়ের রং শ্যামল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বয়স ছাব্বিশ সাতাশ হবে। হেসে দিয়ে বলল,
- আসুন ভিতরে বসুন।
মহিব ভিতরে গিয়ে বসল।
- কেমন আছেন?
- জ্বি ভালো।
- ঠিক কি কারনে এসেছেন বুঝতে পারলাম না ।
- ফারিহাকে অনেক জিজ্ঞেস করেও আপনার ব্যাপারে কিছু জানতে পারি নি। জানেনই তো, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের একটু বারতি আগ্রহ থাকে।
- ঠিকানা কোথায় পেলেন?
- আমার শ্বশুর দিয়েছেন।
- ও। বসুন। পানি চড়াচ্ছি। চা খেয়ে যান। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। একা একাই থাকি।
- ফারিহাকে কি আপনি অনেক বেশি ভালোবাসতেন?
- একটু বেশীই। কেনো?
- ফারিহাও আপনাকে খুব ভালোবাসে।
- কিভাবে বুঝলেন ?
- আমি যদি ভুল না করি তাহলে আপনাদের মধ্যে কোনো সমস্যা হয়েছিল।
- হ্যা। আমাকে বলেছিল, ওর বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে। আমি দিই নি।
- দেননি কেনো?
- আমি বেকার ছাত্র ছিলাম । বেকার মানুষের সাথে বিয়ে দিবে কিনা সেটা নিয়ে সংষয়ে ছিলাম।
- আমার একটা মেয়ে হয়েছে।
- তাই নাকি? ভালো তো।
- আপনাকে একটা অনুরোধ করব রাখবেন?
- বলুন
- আপনার নাম টা যেনো কি?
- আবিদ।
- আমার মেয়ের একটা নাম রেখে দিন।
- নাম রেখে দিন মীরা।
- ধন্যবাদ, মীরা নামই রাখব।
- ওয়েলকাম।
- এটা রাখুন,
- এটা কি?
- আমার অফিসের ঠিকানা। সময় করে আসবেন।
- হ্যা আসব।
তিন বছর হয়ে গিয়েছে, আবিদ আসে নি। আর খবরও নেওয়া হয় নি। ফারিহা খুবই সুন্দরী মেয়ে , তার সাথে ফারিহাকে মানায় না। এ বয়সে মেয়েদের একটু ঘুরেফিরে বেড়ানোর সময়। মহিব এই কাজটি করতে পারে নি। তিনি ফারিহাকে কোনো আনন্দ দিতে পারেন নি। ফারিহা চুপ থাকতে পছন্দ করে। জ্ঞানী মেয়েরা চুপচাপ থাকে। ফারিহা অত্যন্ত জ্ঞানী মেয়ে।
(৪)
ইদ্রিস সাহেবের দাত পড়ে গিয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের দাত পড়া শুরু হয় । ইদ্রিস সাহেবের প্রথম দাত পড়ল। তার অসহ্য লাগছে। সামনের দাতটিই পড়েছে। তিনি হাসতে পারছেন না। নিজের অবস্থা দেখে নিজেরই হাসি পাচ্ছে। কথাও বলছেন না। কথা বললে, সামনের দাতে ফাকা দেখা যাচ্ছে। বাগানে চেয়ার পেতে বসে আছেন। তার সামনে মহিব বসে আছে। মহিব বলল,
-কেমন আছেন?
ইদ্রিস সাহেব রহমানের দিকে তাকালেন। রহমান হাতের খাতাটা এগিয়ে দিল। ইদ্রিস সাহেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে কলম বের করে খাতায় লিখলেন । খাতাটা মহিবের দিকে এগিয়ে দিলেন। মহিব ইতস্তত করে খাতাটি হাতে নিল। খাতায় লেখা
-ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
মহিব বলল, জ্বি ভালো আছি। আপনার কি শরীর খারাপ? কথা না বলে খাতায় লিখে দিলেন কেনো?
ইদ্রিস সাহেব রহমানের দিকে তাকালেন। রহমান বলল
- চাচার দাত পড়ে গেছে। সামনের টা পড়েছে। কথা বললে খারাপ দেখা যায়। তাই সামরিক কথা বন্ধ। খাতায় লিখে লিখে কথা হবে।
মহিব বলল, তাহলে তো বড় রকমের প্রবলেম। ডাক্তার কিছু বলেছে? এভাবে কথা না বললে তো মুখে গন্ধ হবে।
রহমান বলল- জ্বি। ডাক্তার বলেছে নকল দাত লাগায় দিবে।
মহিব বলল- তাহলে ঠিক আছে। তুমি এখন যাও। আঙ্কেলের সাথে আমার পারসোনাল কথা আছে।
ইদ্রিস সাহেব হাত ইসারা করে রহমানকে যেতে বললেন। রহমান চলে গেল।
মহিব বলল - খাতার দরকার নাই। আমি উল্টো দিকে ঘুরছি। আপনি কথা বলুন। আপনার দাত কেউ দেখবে না।
মহিব ঘুরল। ইদ্রিস সাহেব খেঁকানি দিয়ে বললেন,
- কি বলবে বলো
মহিব বলল,- নাইমার জন্য একটা ছেলে দেখেছি।
ইদ্রিস সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন
- নাইমাকে এখন বিয়ে দিব না।
- কাহিনী আছে।
- কি কাহিনী?
- একটা ছেলের প্রেমে হাবুডুবু দিচ্ছে ।
- বলো কি! তুমি জানলা কিভাবে?
- কেনো আপনি জানেন না?
- না। আমার কি জানার কথা ছিল?
- হ্যা। নাইমা তো এরকমই বলল
- ও তাহলে নাইমা বলেছে তোমাকে ?
- হ্যা।
- আর কি কি বলেছে?
- বলেছে, ইন্ডিয়া পালিয়ে যাবে সাহায্য চায়।
- তুমি কি হেল্প করতে চাও?
- আপনি যদি বলেন।
- ছেলে কি করে?
- সাইকেলরিক্সা ঠিক করে, গেরেজ। নিজের না, বাবার।
ইদ্রিস সাহেব খেঁকানি দিয়ে বললেন,
- ক্যানসিল। তোমার কাছে যে পাত্র আছে সে কি করে?
- ছাত্র। গরীব, সামনের বই মেলায় বই বের হতে পারে।
- বই বের হতে পারে! মানে বের হবে কিনা সন্দেহ?
- হ্যা।
- ছেলে কি সুন্দর?
- না। কালো। তবে ভালো।
- তুমি আর ফারিহা একটু খোজ খবর নিয়ে দেখো, যদি ছেলে ভালো হয় তাহলে বিয়ের ব্যবস্থা করো।
- জ্বি আচ্ছা। এবার মুখ বন্ধ করেন।
ফারিহা শুয়ে শুয়ে ভাবছে। কিছুদিন হল, ফারিহার মনে হচ্ছে, মহিবকে তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। মহিব তার সব কথা চুপচাপ মানতে থাকে। লোকটা ভালো তবে, একটু বোকা বোকা। সেদিন ফারিহা জিজ্ঞেস করলো,
- এখন যদি আপনি একটা "আলাদীন চেরাগ" হাতে পান তাহলে কি চাইবেন?
মহিব বলল - কিছুই না। দৈত্য টাকে ছেড়ে দেব। চেরাগ এর দৈত্যেরও তো একটা ইচ্ছা আছে। তাই বলতাম - তুমি তিনটা ইচ্ছা বল আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করব।
ফারিহা হেসে বলল, আপনাকে দিয়ে হবে। আপনি মজাই বোঝেন না।
মহিব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাকিয়ে রইল। মীরা ওর বাবার পাগল । বাবার মধ্যে কি আছে, তা ফারিহা খুঁজে পায় না। ফারিহার মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই কিছু আছে! ফারিহার খুব ইচ্ছা করছে, তার ইচ্ছা গুলো পূরণ করতে। ফারিহার ইচ্ছে করছে, মহিবের কাছে যেতে। কেনো ইচ্ছা করছে, জানে না। এবার যে প্রথম ইচ্ছা করছে তাও না। এর আগেও অনেকবার এরকম ইচ্ছা হয়েছে। কিন্তু যখনই মহিব সামনে আসে ফারিহা কিছু বলতে পারে না। দরজায় টোকা পড়লো। ফারিহা দরজা খুলল। দরজার বাহিরে নাইমা। দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকে পড়লো। সোফায় বসে বলল
- একটা খুশির খবর দেব। তুমি শুনলে খুশী হবা।
ফারিহা কিছু বলল না। নাইমার পাশে এসে বসল। নাইমা বলল
- আমার বিয়ে পাকাপাকি।
- কার সাথে?
- আমার প্রেমিকের সাথে
- মানে?
- মানে টানে নাই। বাবাই বিয়ে দিচ্ছেন।
- বাবা তোর প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছেন তোর?
- হ্যা। জানো কে বিয়ে ঠিক করে দিয়েছে?
- না ।
- মহিব ভাই।
- কে?
- মহিব ভাই।
ফারিহা অবাক হল। মহিব কে সে যেরকম মনে করেছিল তার কারন গুলো আস্তে আস্তে ভুল প্রমানিত হচ্ছে। মহিব ফারিহার মনে যায়গা তৈরি করছে। মহিব লোকটি সম্ভবত বেশী রকমের রহস্যের।
(৫)
ফারিহা খুবই ভয়ানক স্বপ্ন দেখল। খুবই ভয়ানক স্বপ্ন। ফারিহার ভয় হচ্ছে। স্বপ্নে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক তবে, বাস্তবে ভয় পাওয়া মারাক্তক ব্যাপার। ফারিহা বাস্তবেই ভয় পাচ্ছে। ফারিহা বিছানা থেকে উঠে ফ্রেস হলো। জানালার পাশে বসে ছিল, হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। ফারিহা ফোনটা কানে নিলো,
- জ্বি বলুন।
ওপাশ থেকে পুরুষের কন্ঠ বলল
- এটা কি মহিবের বাসা?
- হ্যা।
- আপনি মহিব সাহেবের কি হোন?
- আমি তার স্ত্রী।
- আপনার স্বামীর বুকে দুইটা গুলি লেগেছে। তার অবস্থা খুবই খারাপ। আপনি কি আসবেন?
ফারিহার বুক ধপ করে ফাকা হয়ে গেলো। মাথা ভারি হয়ে যাচ্ছে। কোনো রকমে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলো
- কোথায় আসতে হবে বলুন
- গুলশান হাসান হাসপাতাল।
- ঠিক আছে আমি আসছি।
ফারিহা পাশের ঘরে গেলো। মীরা খেলছিলো। মীরাকে সাথে নিয়ে ফারিহা হাসপাতালে চলে গেলো।
ইদ্রিস সাহেব বেশ চিন্তিত। তিনি ভয়ে আছেন । ডাক্তার বলেছে, দোয়া করতে থাকেন। আমরা চেষ্টা করছি।
জব্বার সাহেব মেঝেতে বসে আছেন। এরই মধ্যে তিনি তিনবার কান্না করেছেন। এখন চুপ করে বসে আছেন।এখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে।
নাইমা মীরাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মীরা চুপ হয়ে বসে আছে। সে কিছু বুঝতে পারছে না। একটু পর পর একজন ডাক্তার বের হচ্ছে আর নানু জিজ্ঞেস করছেন, অবস্থা কি অবস্থা কি? মা চুপ করে আছেন । একটু পরপর চোখের পানি পড়ছে। মার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নাইমা আন্টিও চুপ হয়ে বসে আছে। একজন লোককে বলতে শুনলো, মিলিটারি গুলি করেছে। লোকটার গায়ে রক্ত দিয়ে মাখামাখি। নানু জিজ্ঞেস করলেন, ওর গায়ে গুলি লাগবে কেনো? ও তো গাড়িতে ছিলো। লোকটি বলল সে জানে না। সে বাবাকে রাস্তায় পেয়েছে। পকেটে অফিসের কার্ড পেয়েছিলো। কার্ড থেকে নাম্বার দিয়ে হাসপাতাল থেকে কল করেছেন। নানু লোকটিকে ধন্যবাদ দিলো। লোকটি চলে গেলো। মীরা কিছু বুঝতে পারছে না। বাবার কি হয়েছে? মিলিটারিররা কেনো বাবাকে গুলি করলো কিছুই জানে না। মীরার বাবার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। সকালে বাবা মীরাকে একটি ধাধা জিজ্ঞেস করেছিলো। বাবা বলেছিলো বিকেলে জবাব দেবে। বাবা কখনোই উত্তর দিতে পারে না। মীরাকেই জবাব দিতে হয়। বাবা না পেরে বলে, ইস! আমি ভেবেছিলাম এটা হতে পারে। মীরা ভালো করে জানে বাবা মিথ্যে বলে। বাবা ধাধা পারে না। কিন্তু বাবা মিথ্যুক না। বাবা অনেক ভালো মানুষ।
ডাক্তার বের হলো। ডাক্তারের মুখে চিন্তা। ইদ্রিস সাহেব সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ডাক্তার বললো, প্রচুর রক্ত বের হয়েছে। গুলি লেগেছে, বুকে। পড়ে গিয়ে মাথা ফেটেছে। মাথা থেকে অনেক রক্ত পড়েছে। আপাতত, গুলি বের করা শেষ হয়েছে। রুগী ফারিহার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন। ফারিহা কে? ইদ্রিস সাহেব ফারিহাকে দেখিয়ে দিলেন।
ফারিহা মহিবের সামনে বসে আছে। মহিব বলল,
- মহাখালী থেকে ফুল কিনছিলাম। হঠাৎ লোকজনের চিৎকারের শব্দ শুনলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি লেগে গেলো। আর কিছু মনে নেই।
ফারিহা তাকিয়ে রইলো।
- আমি বাঁচবো না।
ফারিহা এর আগে কখনোই বলে নি যে মহিবকে সে ভালোবাসে। আজকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে। ফারিহা মহিবের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
- আই লাভ ইউ।
মহিব চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলো। ফারিহা বলল
- আই লাভ ইউ
ফারিহা আবারও বলল,
- আমি তোমাকে ভালোবাসি।
মহিব চোখ বন্ধ করে আবার চোখ খুলে তাকালো। ফারিহাকে বললো ,
- আমিও তোমাকে ভালো বাসি।
ফারিহার বুকে ঢেউ খেলে গেলো। মহিবের মাথায় ব্যান্ডেজ করা। ফারিহা মহিবের মুখে হাত দিলো। মহিব বলল, মীরাকে ডাকো। ফারিহা মীরাকে সাথে নিয়ে ঢুকলো। মহিব বলল,
- আমি তোমার ধাধার উত্তর বের করতে পারিনি।
- আমি জানি।
- উত্তর টা কি বলবে ?
- পরে বলল। তোমার কি হয়েছে বাবা?
- কিছু হয় নি। তোমাকে একটু দেখবো।
- আচ্ছা দেখো
ডাক্তার রুমে ঢুকলেন। ডাক্তার বললেন,, আপনারা এখন যান। রোগীকে একা থাকতে দিন। ফারিহা মীরাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো।
রাত আড়াইটা। মীরার ঘুম ভাঙল কান্নার শব্দে। মা কান্না করছে। সবাই খুব চিন্তিত। পাশে বাবা শুয়ে আছে। ডাক্তার সাহেব চিন্তিত। ডাক্তার নানুর দিকে তাকাচ্ছেন, বাবার হাত ধরে আছেন। মা কান্না করছে। মীরা ওর মাকে কখনো কান্না করতে দেখে নি। আজকে অনেক কান্না করছে । মীরা বাবার দিকে তাকালো। বাবা কি যেনো বলতে চাচ্ছেন, শোনা যাচ্ছে না। বাবার অনেক কষ্ট হচ্ছে। বাবা চোখ বন্ধ করছেন আবার চোখ খুলছেন। রহমান আঙ্কেল বাবার পায়ে হাত ঘসছেন। জব্বার আঙ্কেল চিন্তিত ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। মীরা কিছুই বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে! বাবা চোখ বন্ধ করেছে অনেকক্ষণ হলো। চোখ খুলছে না। ডাক্তার সাহেব হাত ছেড়ে দিলেন। নানু চোখে হাত দিলেন। নাইমা আন্টির চোখে পানি। মা চিৎকার দিলেন। মার চিৎকার শুনে মীরার ভয় হলো। ভয়ে মীরাও চিৎকার করে উঠলো।
বি.দ্র. পুরো গল্পটাই কল্পনার ফসল। আমি কল্পনা করেছি, যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে একটা মানুষকে ঘিরে কিছু স্বপ্ন তৈরি হওয়ার পরে সেই স্বপ্নে পানি ঢেলে দিলে কেমন হয়। এই মোতাবেক লিখেছি। লিখতে লিখতে চিন্তা করেছি, না লিখব না। কয়েকবার লেখা বন্ধ করে চা খেয়েছি, ঘুমিয়েছি। ভেবেছি, এরকম গল্প। মহিব, মীরা, ফারিহার মতো তিরিশ লক্ষ মানুষের গল্প কি আমরা জানি? আমরা কি জানতে পারব? যদি এরকম কোনো ঘটনা ঘটে থাকে আমাদের কি তা জানার উপায় আছে? না নেই। আমার লেখার হাত ভালো না। লেখায় অনেক ভুল করেছি। কিছু বিরক্তিকর বিষয় তুলে ধরেছি। বোঝাই যাচ্ছে, আমি ব্যর্থ। শেষ পর্যন্ত না পড়ে অনেকেই চলে গিয়েছেন । তবে আমি চেষ্টা করেছি। তিরিশ লক্ষ গল্পের একটা গল্প তুলে ধরেছি । যার কোনো দলিল নেই। সত্যি হতেও পারে, নাও হতে পারে। সাজানো জীবনকে দুঃক্ষময় করার জন্য এসব গল্প অভিশাপ হয়ে থাকুক পাকিস্তানী জানোয়ারদের জন্য । যারা তিরিশ লক্ষ মানুষের সাদা জীবনে রঙিন কালো একে দিয়েছে।
শুভ্র আহমেদ
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment