পৃষ্ঠাসমূহ

Wednesday, February 25, 2015


গাঁও গ্রামের ফর্সা রূপ : জিয়া হাশান

সবাই বলে গাঁও-গ্রাম বদলে গেছে। উন্নয়নি ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির কোমল পরশে তার রূপের ছটা এখন ঝলমলায়। এনজিও বটিকায় বলিয়ান বাহু-পেশি চার ইঞ্চি ফোলে। ইদানিং আমাকে প্রায়ই গ্রামে যেতে হয়। নিজেরটায় তো বটেই রাজধানীর আশপাশে কিংবা দেশের অন্যত্রও। কিন্তু কোথাও তো চোখে পড়ে না বদলানো ফর্সা রূপ। পেশি ফোলানো ভঙ্গি। বরং আগে যেমন ছিল তেমনি সবুজ-শ্যামলই তো আছে। খাল-নদী বিধৌত কাদাময় নোংরা এখনো তার স্বভাব-চরিত্র। তাহলে বদলালো কী? পাল্টালো কোন অঙ্গ? খুঁজতে খুঁজতে একদিন পেয়ে যাই। চোখে পড়ে তার অন্য রকম চেহারা। ভিন্ন রকম স্বভাব-চরিত্র। যা আগে কখনো দেখিনি। হয়তো অনেকের ভাবনায়ও আসেনি।

বিভক্তির দগদগে তাজা ঘা’র কারণে দেশের আর সব ইউনিয়নের পঙতি থেকে আমাদেরটা ছিটকে পড়ে। তাই তারে মাহরুম করে আর সব ইউনিয়ন দফায় দফায় নির্বাচন সেরে নেয়। ঘাড়ে তোলে নতুন জনপ্রতিনিধি। আমাদেরটা তখন ভোটার তালিকা দুভাগ করে ফাইনাল এ্যাপ্রুভালের জন্য গোমরা মুখে চেয়ে থাকে। এ কালো মুখে কাটে বেশ কয়েক মাস। তারপর একদিন নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়। ইউনিয়নজুড়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা মাথা তোলে।

আমাদের ভাই, মেজ চাচার বড় ছেলে অভিবক্ত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। বিভক্তির পর ঘরের দুয়ারের ইউনিয়ন পরিষদের হর্তকর্তা হবার চান্স হাতছাড়া করতে নারাজ। সুতরাং আদাজল খেয়ে নামেন, কাছা দিয়া মাঠ, নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়ান। আমারে ফোন দেন-‘আবার খারাইছি। ক্যাম্পেন করতে হবে, আবি? ইলেকশন কিন্তু ঘনাইয়্যা আইছে।’
রথ দেখা আর কলা বেচা, গ্রাম দেখা আর ক্যাম্পেইন করার বেশ যুৎসই চান্স হাতছাড়া করি কী করে। তাই অফিস থেকে এক সপ্তাহের ছুটি ম্যানেজ করে ছুটি আমাদের পৈত্রিক গ্রামে।

আমাদের গ্রামটা সম্ভবত অজপাড়া গাঁ’র সেরা দৃষ্টান্ত। বিল ডুমুরিয়া নামের সাথেই অজত্বের দগদগে পরিচয় আঁকা। কারণ পুরো গ্রাম বিলের কব্জায় পোড়া। তার মাঝে মাঝে ঢিবির মতো উঁচা করা কিছু বাড়ি। শুধু বর্ষায় নয়, বরং শীত-বসন্তেও নৌকা ছাড়া বাড়ির বাইরে পা ফেলার উপায় নাই। বারো মাসই চারিদিকে পানির কঠিন রাজত্ব। তারে ফাঁকি দিতে, তার নাগপাশ থেকে শ্বাস ফেলতে কচুরিপানা জড়ো করে ‘ধাপ’ বানায়ে তার ওপর শাক-সবজি আবাদের এক অভিনব পদ্ধতি আমাদের পূর্বপুরুষরা আবিস্কার করেছেন। তা-ই এখন আমাদের ভরসা। তার বাহারি সবুজ রংয়ের ছটা ইদানিং দেশবাসীকে তাক লাগিয়েছে। কারণ আমাদের গ্রামের অভিনব কৃষিপদ্ধতি নিয়া কয়েকটি পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন-ফিচার আইটেম অনেকেইর চোখে পড়েছে।

যাইহোক, এরকম পান্ডববর্জিত বলা কম হবে বরং তাদের ধারণার অতীত গাঁকে উন্নয়নের বামন হাত নাগালে পাবে সে আশা করা বতুলতা। তাই রাস্তা-ঘাট, পোল-ব্রিজ বিদ্যুৎ ইত্যাদি দিয়া তার ‘ছতর’ ঢাকার জরুরী ‘ফরজ’ পোশাক-আশাক থেকে সে বঞ্চিত। উদলা উলঙ্গ তার গা-গতর। তবে দুএকটা হাটবাজারে ছোপ ছোপ উন্নয়নের আঁচড় কিছুদিন আগে লক্ষ্য করা গেছে।

রাস্তা-ঘাটের অভাবে নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলে নৌকা-ট্রলারে। জলপথে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি গিয়া ভোট প্রার্থনায় হাত মিলাই, সালাম বিনিময় করি। প্রথম দুদিনের পর তৃতীয় দিনের মাথায় মোক্ষম ঘটনা মাথা চাড়া দেয়। প্রত্যক্ষ করি গ্রামের, তার অন্তর বদলানোর, ফর্সা রূপ ধারণের তরতাজা আলামত।

সেদিন আমাদের বাড়ির সবচেয়ে কাছের হাট, তাও নৌপথে প্রায় একঘন্টার আগায় মনোহরপুরে ক্যাম্পেইনের সিডিউল। কাগজ-কলমে হাটের এ রকম রমনীয় নাম হলেও আমরা তারে আদর করে, মাথায় হাত বুলায়ে ডাকি মোনারপাড়। তিনখালের মোহনা সামনে নিয়া তার জীর্ণ আসন। কেননা মোহনাতেই, মানে খালেই বসে হাটের মূল আসর প্রতি শুক্র ও সোমবার সকালভাগে। নৌকায় নৌকায়, ইদানিং অনেকে পুচ্ছে স্যালো লাগায়ে ট্রলার নাম ধারণ করছে, তাতে চলে শাক-সবজি আলু-পটল কপি-কুমড়ার দরদাম হাঁকাহাঁকি কেনাবেচার হৈ হুল্লোড়। সূর্য মাথার ওপর ওঠার আগেই ব্যাপারি-ফরিয়ারা ভাটার পথ ধরে। বড় গঞ্জ বা শহর পানে তাদের মুখ। তাই তাদের আর কূলে ওঠার দরকার পড়ে না। ফলে কূলের আসর ম্যাড়ম্যাড়ে, ছাড়াছাড়া ভাব তার। দুসারিতে মুখোমুখি দাঁড়ানো খানকতক দোকান। তার বেশিভাগই লুঙ্গি-গামছা শাড়ির দখলে। আর দু একটায় অষুধপত্র ঝাঁকিয়ে বসলেও বাকিগুলায় মুদি-মনোহারিসহ হরেক রকম কারবার। মোট কথা কূলের গা-গতর এতো ছোট যে, যে কোনখানে দাঁড়ায়ে পুরা হাটে একনজর বুলানো, সবগুলো দোকানপাট এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা সম্ভব।

পথে আরো দুএক জায়গায় ক্যাম্পেইন সেরে হাটে গিয়া দেখি সে ভেঙ্গে গেছে। একেবারে চৌচির–খাল খালি,ব্যাপারিরা সব ভাটির পথে। কূলের বেশির ভাগ দোকানপাট মুখে ঘোমটা নামিয়েছে। ঝাঁপ ফেলে দোকানিরাও বাড়ির পথে। শুক্রবার বিধায় জুম্মার নামাজ হাতছানি দিয়া তাদের আগেভাগে ডেকে নেয়।

আমরা গিয়া হাটের নির্বাচনী ক্যাম্প অফিসে আসর জমানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ভাঙ্গা হাট কি জোড়া লাগে? খালি মাঠে অনায়াসে গোল দেয়া যায় কিন্তু ক্যাম্পেইন চলে না। তাহলে কী হবে? খালি হাতে ফেরৎ? তা কি করে হয়, এতো দূর এতোখানি পথ পাড়ি দিয়া আসা। বুথ এজেন্টের ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দরকার, তাও কি হবে না?
আমি অবাক হয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থীর মুখ পানে তাকাই। বিদ্যুৎ নাই তারপরও তার ফটোকপি মেশিন খোঁজা কেনো? তারপর হাটে দুবার চক্কর দেয়া সারা, দোকারপাটের চেহারা-সুরত পড়া শেষ। কিন্তু ফটো স্টুডিও কই? একবারও নজরে পড়েনি।
চেয়ারম্যান প্রার্থীর নির্দেশে আমাদের বহরের কেউ একজন ‘তসলিম ভাই! তসলিম ভাই!! এদিগে আহো’ বলে গলা উঁচা করে। তার কিছুক্ষণ পর ত্রিশের কোঠার এক যুবক এসে হাজির। বুঝি এ-ই তসলিম। তাকে দেখে আমার অবাক হবার পালা। কেননা তার বগল তলে ধরা আস্তো একখান ল্যাপটপ। বারো ইঞ্চি তসিবা। কিন্তু তার পরনের চেক লুঙ্গি কাছা দেয়া, গান্ধীজীর নেংটির মতো করে কোমরের কাছে গুটানো। তার নিচে হাঁটু অবদি তাজা কাদায় মোড়া। তারপর বাদামী থেকে কালোর দিকে ঝুঁকে পড়া বাকি পুরা শরীর খোলা। আমরা দেশি ভাষায় বলি উদলা গা। পাতলা গামছাখানাও গায়ে নাই। কোমরে কষে বাঁধা। তার মানে সে ডাক শুনে হাটের পাশের ধান ক্ষেত থেকে উঠে এলো? আমাদের বহরের একজন ঘাড় কাত করে হাঁ জানায়। ফলে আমার কৌতূহল আরো উঁচুতে মাথা তোলে। তার পানে অপলক চোখে তাকায়ে থাকি।
কার কার ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রিন্ট লাগবে তা জেনে নিয়া সে আগায়। আমি ক্যাম্প অফিস ছেড়ে তার পিছু নেই। দেখি সে কী করে। কোথা থেকে ছবি, পরিচয়পত্রের প্রিন্ট আমদানি করে।

দুদোকান পরেই তসলিমের আস্তানা। টিনের ঘোমটা তোলার পর ভেতরটায় নজর পড়ে। সামনের অংশে ছোটো একটি টেবিল, তার ওপর প্রিন্টার আর হাজারো রকমের তারের সমাহার। আর পার্টেক্স বোর্ডের পার্টিশনের ভেতরে অন্দরমহল। তসলিম তার ভেতরে যাবার পরপরই ভটভট আওয়াজ গলা তোলে। তার মানে স্যালো মেশিনের জেনারেটরের দৌড় শুরু হল। সামনে এসে টেবিলে রাখা ল্যাপটপের সাথে এটা ওটা তারের সংযোগ দেয়। তারপর শুরু হয় তার হাতের খেলা– ল্যাপটপের ‘টাচ প্যাডে’ দ্রুত আঙ্গুল চালায়। সাথে সাথে প্রিন্টার ওগড়ায় ছবি আর পরিচয়পত্র।

বিভিন্ন দেশে ডালপালা ছড়ানো একটি শীর্ষস্থানীয় আধা করপোরেট অফিসে আমার চাকরি। তার কোর ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। সেখানে দেশি-বিদেশী লোকজনের আসা যাওয়া। ল্যাপটপ, আইপ্যাড ইত্যাদির অবাধ দৌরাত্ম্য। সুতরাং ল্যাপটপের মাধ্যমে ছবি ও পরিচয়পত্রের প্রিন্ট বার করা দেখে আমার অবাক হবার কী আছে। হা হয়ে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে দেখা কেনো?
কিন্তু দেশসেরা অজপাড়া গাঁয়ের দু ইঞ্চি সাইজের হাটে এইমাত্র খেত থেকে হাঁটু অবদি তাজা কাদা নিয়া খালি গায়ে উঠে এসে এক যুবক চাষি লোহার মতো কর্কশ আঙুলের ছোঁয়া ল্যাপটপের সাথে কথা বলছে, পরশে পরশে তার দেহ মনে উত্তেজনা সঞ্চার করছে। তারপর তার গর্ভ থেকে একটার পর একটা ছবি, পরিচয়পত্রের প্রিন্ট বার করছে, তা দেখে চোখ বড় না করে উপায় আছে? আর বলি বা কী করে গ্রাম বদলায়নি? তার ফর্সা রূপ হয়নি?
দুকদম আগায়ে তসলিমের মুখোমুখি হই– তুমি এতো কিছু শিখছো কই? কার কাছ থাইকা?
কয়দিন ইন্দেরহাডে (আমাদের বাড়ির কাছের সবচেয়ে বড় গঞ্জ কাম হাট) এ্যাক দোকানে কাম করছি। হেহানে শিখছি। বাড়ি আইয়্যা এনজিও থাইকা লোন নিয়া এ্যাই কারবার খুলছি। এলাকার হগোলের ছবি, পরিচয়পত্র ল্যাপটপে ভইরা রাখছি। যহন যার লাগে প্রিন্ট দেই। ছবিতে দশ ট্যাহা, পরিচয়পত্রে পাঁচ ট্যাহা লই। খ্যাতের কামের ফাহে ফাহে কারবার চালাই। মাসের শ্যাষে কিস্তি দিয়াও লাভ থাকে।

জিয়া হাশান

লড়াকু রেশমা আর সুলতানা-জমিলাদের প্রতিবাদ : জোবাইদা নাসরীন


এক

রেশমারা্ বেঁচে থাকে, বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে ওরা প্রমাণ করে পুঁজিবাদী দুনিয়াতে ওরাই বড় সত্য, এর চেয়ে বড় আর কোনোটি নয়। সাভারে রানা প্লাজা ধসের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া হাজারের বেশি লাশের বহর এখন পর্যন্ত আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্ট, যন্ত্রণার জায়গা। কিন্তু তবুও ঘটনার সতের দিন পর বাতাস ভারি করা দুর্গন্ধ, শেষ সম্বল ছবিটিকে বুকে আঁকড়ে স্বজনদের আহাজারি, হাড়গোড় আর কঙ্কালের ভিড় ঠেলে জীবিত রেশমা সকল উৎকণ্ঠা, জিজ্ঞাসা ও বিস্ময় পাশ কাটিয়ে হাজির হয়েছে।

রেশমা আমাদের কাছে ফিরে এসেছে এটাই বড় সত্য। তাই আমাদের চোখের সামনে যখন বারবার আগুনেপোড়া আর ধ্বংসস্তূপে চাপাপড়া জীবনগুলো ছাই হয়ে যায়, আমাদের স্বপ্ন্ থেকে ফসকে যায়, তখন আমরা কেবলই মানবিক হাহাকারের জপ তুলি। কিন্তু কিছুই বন্ধ হয় না। সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের আন্দোলিত করে কিছু এজাজউদ্দিন কায়কোবাদের মতো মানবিক মানুষের মুখ। শাহীনার মৃত্যু কাঁদিয়েছে আমাদের, বিনম্র শ্রদ্ধায় চোখের জল আনিয়েছে কায়কোবাদের বিদায় সংবাদটি।

এতকিছুর মধ্যে রেশমার বেঁচে থাকা এবং উদ্ধার হওয়া সকল পুঁজিবাদী বায়নার বিপরীতে বিরাট অর্জন। বিয়াল্লিশ বছর বয়সী বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা অনেক। দক্ষ জনবলের বিপরীতে মানবিকতার ওপর ভর দিয়ে এদেশের মানুষ সাহসের যে লাঠিটি তুলে ধরেছে উদ্ধারকাজে তা বাংলাদেশ অনেকদিন মনে রাখবে।

15_Reshma_100513

দুই

প্রতিবাদী নারী গণসমাবেশ হয়ে গেল। এ সমাবেশে যোগ দেওয়ার কথা ছিল রড-সিমেন্ট আর বড় বড় লোহার রডে ছিদ্র ও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া জীবনগুলোর। আমাদের ভোঁতা হয়ে যাওয়া ইন্দ্রিয়গুলো অবসরে সচল হয়ে ওঠে, আমরা কেবলই লাশ দেখি, কেবলই বাঁচার আকুতি শুনি। আর এ আকুতি আমাদের নিয়ে যায় প্রতিরোধের দরবারে। এদেশের নারীর লড়া্ই বারোয়ারি। ঘরে-বাইরে তার লড়াই। শুধু পুরুষতন্ত্রই তার শত্রু নয়, তার শত্রু অনেক। রাষ্ট্র ও সমাজের নানা বৈষম্যের উপাদান, সবকিছুই নারীর বিরুদ্ধে কাজ করে। পুঁজিবাদ, ধর্ম, বর্ণবাদ, জাতিভেদ সকল কিছুর সঙ্গে হাত ধরে এগিয়ে চলে পুরুষতন্ত্র আর ব্যবহৃত হয় নারীর বিরুদ্ধে। একেক জন এগোয় এগুলোকে বগলদাবা করে।

বাংলাদেশে যখন চলছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য আন্দোলন, তখনই গজায় হেফাজতে ইসলাম। নারীবিদ্বেষী দুই দফা, সংবিধানবিরোধী আরও কয়েক দফা সম্বল করে দুই পর্বে আমাদের সামনে হাজির হয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। বিরোধী দলনেত্রী চোখ বুজে এ তের দফায় সমর্থনই শুধু দেননি, এ দেশের মানুষকে আহবান জানিয়েছেন হেফাজতের পাশে দাঁড়াতে। সরকারি দল সুযোগ করে দিয়েছে এ দফাগুলো প্রচার করার জন্য। কেউ রুখে দাঁড়ানোর কথা বলেননি। নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতা করার পাশাপাশি হেফাজত প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ বন্ধের দাবি তোলে।

এরই প্রতিবাদে ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে নারীরা প্রতিবাদী সমাবেশ-মিছিল বের করে। আজকের এ নারী মহসমাবেশ হেফাজতের নারীবিদ্বেষ কেন্দ্র করে হলেও এ পাটাতন বাংলাদেশের অনেকগুলো অমীমাংসিত বিষয়ের ফয়সালা স্পষ্টতই চায়। বাস্তবতা পাশ কাটিয়ে নয় বরং নারীবিদ্বেষের সকল দ্বারকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই লড়াই-এর ময়দানে থাকতে চায় নারী। আর চায় বলেই এ ময়দানের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক এবং সমতার বাংলাদেশ তৈরি করা নারীর মতাদর্শিক জায়গা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও ওই সমতার জায়গাটি তৈরি করার জোর তাগিদে এ সমাবেশ। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে, একজন শহীদ পিতার সন্তান হিসেবে আমরা যে গর্ববোধ করি, একজন বীরঙ্গনার সন্তান হিসেবেও পরিচয়ের সমপরিমাণ গর্ব আমরা চাই। মুক্তিযুদ্ধের পৌরুষদীপ্ত ইতিহাসের বিপরীতে লৈঙ্গিক সমতাভিত্তিক ইতিহাস এ নারীরা তৈরি করবেন।

সমাবেশ আরও বলছে নারীনীতির কথা, তা বাস্তবায়নের কথা। সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরষের সমঅধিকারের কথা, বলছে সিডও সনদ বাস্তবায়নের কথা। নারীর বিরুদ্ধে সকল ধরনের নির্যাতন, নিপীড়নের বিপক্ষে দাঁড়ানোর কথা। আরও বলছে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথের কথা, মতের কথা, ঈর্ষণীয় সংগ্রামের কথা।



তিন

ইবসেনের নোরা সংসার থেকে বের হয়ে গিয়েছিল পুতুলঘরে থাকবে না বলে। আর সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর জমিলা ধর্মীয় ভণ্ডামির বিরুদ্ধাচরণ করে থুতু ছিটিয়েছিল মজিদের মুখে। সুলতানার স্বপ্ন এখনও এ দেশের নারীর আরাধ্য। তবু এ দেশের নারীই পারে সন্তান বুকে নিয়ে, কোলে নিয়ে শরণার্থী হয়ে শিবিরে শিবিরে দৌড়াতে, পারে ভেঙে যাওয়া ভেসে যাওয়া ঘরখানির টুকরো খুঁজে এনে আবার সংসার গড়তে। কলাগাছের ভেলায় কিংবা টিনের চালে বসে খড়কুটো সংগ্রহ করে রান্না করে সকলকে বাঁচিয়ে রাখার স্পর্ধা দেখাতে।

এত সামর্থ আছে বলেই নারীর ঘরে-বাইরে এত শত্রু। আর তাদের মোকাবেলা করেই তাকে টিকে থাকতে হয়। এ জন্য এ দেশের সকল সংগ্রামী নারীর জীবন এত সমৃদ্ধ, এত দৃঢ়। জীবনের বিস্ময় কাটে না এ সংগ্রামী নারীদের পথ দেখে জীবন চিনে নেওয়ার, ছেনে নেওয়ার দুর্দমনীয় সাহস দেখে। শ্লোগানে শ্লোগানে মানবিকবোধের জয়গান শুনে।

আর রেশমাদের সতের দিন পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা পড়ে।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।