The Daily Vorer Pata
১২ জানুয়ারি ২০১৫, সোমবার
রাজধানীর ডেমরা ভূমি অফিসের দেয়ালে একটি বিজ্ঞপ্তি লেখা আছে- নামজারি ফি বাবদ আবেদন কোর্ট ফি ৫ টাকা, নোটিশ জারির ফি ২ টাকা, রেকর্ড সংশোধন ও পরচা ফি ২২৫ টাকা। আবেদনের ৪৫ দিনের মধ্যে নামজারি সম্পন্ন করার কথা উল্লেখ থাকলেও বর্তমানে নামজারি করতে গেলে এসব দিনক্ষণ শুধু বিজ্ঞপ্তিতে শোভা পায় বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা। ৪৫ দিন তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে এক বছরেও নামজারির মামলা নিষ্পত্তি হয় না। নামজারি মামলায় সরকার ২৩২ টাকা ফি নির্ধারণ করে দিলেও ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা ঘাটে ঘাটে সর্বনিম্ন ২০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে নেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ডেমরা ভূমি অফিসে নামজারি করতে আসা জহিরুল ইসলাম শাহীন নামে এক ভুক্তভোগী ভোরের পাতাকে জানান, ‘ভূমি অফিসে প্রতিটি কাজেই নির্ধারিত ফি’র চেয়ে অধিক বেশি টাকা দিতে হয়। জমির নামজারি, জমা খারিজ, মিস কেসসহ বিভিন্ন কাজে ঘুষ ছাড়া চলে না এ ভূমি অফিসে।’ এসব ক্ষেত্রে খরচের হার সাইন বোর্ডে নির্ধারণ করা থাকলেও তা মানছেন না কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সাইন বোর্ডে নির্ধারিত ফির চেয়ে অনেক গুণ বেশি টাকা গুনতে হয় জমির মালিকদের। তারপরও টাকা দিয়ে পার পাওয়া যাবে সে নিশ্চয়তাটুকু নেই এই অফিসে সেবা গ্রহণকারীদের। অফিসে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। আর তাদের ভোগান্তি যেন দেখার কেউ নেই! ৫টি সার্কেল অফিসের হালচাল : দুর্নীতি, অনিয়ম আর ভোগান্তির স্বর্গরাজ্য হয়েছে রাজধানীতে অবস্থিত সহকারী ভূমি কমিশনারের ৫টি সার্কেল অফিস, তহসিল অফিস, জেলা প্রশাসকের আওতাধীন রেকর্ড রুম, ভূমি অধিগ্রহণ শাখা এবং ভূমি জরিপ অধিদফতর। সাধারণ মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানে সেবার পরিবর্তে শিকার হচ্ছেন সীমাহীন ভোগান্তির। তেজগাঁও, ডেমরা, ধানম-ি, মোহাম্মদপুর ও কোতোয়ালি- এ ৫টি সার্কেল অফিস ও জেলার রেকর্ড রুমে দালাল, উমেদার এবং তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের খপ্পরে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ভূমি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র আর পর্চা। টাকা ছাড়া এখানে কোনো কাজ হয় না। এমন অভিযোগ রয়েছে টাকা দিলে মৃত মানুষের নামেও বের হচ্ছে পর্চা। বিভিন্ন জরিপ, সংশোধন, তদন্তের নামেও হচ্ছে লাখ লাখ টাকার দুর্নীতি। জমা-খারিজ, নামজারি (মিউটিশন), নামজারি সংক্রান্ত বিভিন্ন সংশোধন, মূল দলিল, ভায়া দলিলের সার্টিফাইড কপি, মিস কেইস দায়ের, ভূমি কর পরিশোধ, রেকর্ড সংশোধন, আরএস, এসআর ও মহানগর পর্চা কপি, এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ভুলভ্রান্তি সংশোধন, মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি ওয়াশিরদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দেওয়া মূলত এসি (ল্যান্ড) অফিস ও স্থানীয় তহসিল অফিসের কাজ।
জানা যায়, ঢাকার ৫টি ভূমি সার্কেল অফিসে প্রতিদিন গড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার মানুষ আসে তাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। প্রতিটি সার্কেলের প্রধান হলেন একজন সহকারী কমিশনার। এছাড়াও কাগজে-কলমে প্রতিটি সার্কেলে কানুনগো, সার্ভেয়ার, নাজির, মিউটেশন ক্লার্ক, প্রসেস সার্ভেয়ার, পিয়নসহ মোট ১০ থেকে ১২ জন স্টাফ কাজ করছেন। কিন্তু বাস্তবে সার্কেল অফিসগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি অফিসকে ঘিরে আছে কমপক্ষে ৪০/৫০ জন। বাকিরা সরকারি বেতনভুক্ত না হয়েও নিজেদের স্টাফ (ওমেদার) পরিচয় দিয়ে লাগামহীনভাবে চালাচ্ছেন দুর্নীতি আর লুটপাট। এদের জন্য সরকারিভাবে কোনো বেতন-ভাতা না থাকলেও তাদের মাসিক আয় একজন সহকারী কমিশনারের চেয়ে বেশি বলে জানা যায়।
দালালচক্র : অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছত্রছায়ায় প্রতিটি ভূমি অফিসে গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ দালালচক্র। এ চক্রটি এমনভাবে ভূমি অফিসগুলোকে ঘিরে রেখেছে যে তাদের অতিরিক্ত টাকা দেওয়া ছাড়া সেখানে কোনো কাজ করিয়ে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর এভাবেই প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে বছরের পর বছর ধরে ভূমি অফিসের কার্যক্রম। কেউ যদি এ দালালচক্রকে অতিরিক্ত টাকা না দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে ভূমি অফিস থেকে তার প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে চান তাহলে অবশ্যই তাকে কোনো না কোনো হয়রানির শিকার হতে হবে। ডেমরা ভূমি অফিসের ভূমি রেকর্ড ও জরিপ বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ভূমি অফিসগুলোতে প্রকাশ্যে দুর্নীতি হয়- এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে ভূমি অফিসকে ঘিরে স্থানীয় কিছু দালালচক্র গড়ে ওঠায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অফিসের কাজকর্ম মূলত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আমরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি।’
টিআইবির জরিপ : ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির পরিচালিত এক জরিপে জানা যায়, জমির মিউটেশন, রেজিস্ট্রেশন, ভূমি সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ বা অনুসন্ধান ও সরকারি জমি বরাদ্দ থেকে শুরু করে আরো অনেক কাজ রয়েছে যেগুলোকে পুঁজি করে এসব দালালচক্র সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। ২০১২ সালে দেশের ৭,৫৫৪টি পরিবারের ওপর টিআইবির পরিচালিত এক জরিপে জানা যায়, এসব পরিবারের ৯২ শতাংশই বলেছে ভূমি অফিসের কাজ সম্পন্ন করতে তাদের অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়েছে।
জরিপে আরো দেখা গেছে, সময়মত ভূমি অফিসের কাজ আদায় করার জন্য প্রত্যেককে গড়ে ৭,৮০৭ টাকা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়। ভূমি অফিসগুলোর এ দ–র্নীতি রোধ করতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। ২০১১ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ নিরসনের লক্ষ্যে ভূমি অফিসের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিভাগীয় ও উপকমিশনারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় ভূমি সচিব মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমানের পক্ষ থেকে দেশের ৭টি বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪টি জেলার উপকমিশনারদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।
কিন্তু এখন পর্যস্ত তৃণমূল পর্যায়ে ভূমি অফিসের কোনো অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে উপকমিশনারদের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভূমি অফিসের দুর্নীতি নিরসনে ভূমি মন্ত্রণালয় কি ব্যবস্থা নিচ্ছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ বলেন, ‘সব ভূমি অফিসের যে কোনো দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং ভূমি অফিসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্ দালালচক্রের অপসারণ করা হবে।’
ভূমি অফিসের উর্নীতি নিরসনে মন্ত্রণালয়ের নতুন কোনো নির্দেশনা আছে কিনা তা জানতে চাইলে ভূমি সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান, ‘এ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি।
No comments:
Post a Comment