পৃষ্ঠাসমূহ

Tuesday, January 13, 2015

তর্ক বিতর্কের প্রতিযোগিতা



স্কুল-কলেজে অনেক ছেলেমেয়েই বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। শুধু তর্কের খাতিরে তর্ক না, অনেক জরুরি বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা সমালোচনা হয়। একপক্ষ আরেকপক্ষকে তর্কে হারিয়ে জিতে যায় এই প্রতিযোগিতায়। এই বিতর্কের প্রতিযোগিতা এখন স্কুল-কলেজের সীমানা পেরিয়ে দেশের বাইরে যেয়ে পোঁছেছে।

কয়েকদিন আগেই জার্মানির বার্লিনে হয়ে গেল ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ। এটি ছিল বিশ্ব বিতর্ক প্রতিযোগিতার ৩৩তম আসর। এই বিতর্কে এবার ৮২ টি দেশের প্রায় ৪০০ টি দল অংশ নেয়। বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আকিব ফারহান হোসেন ও রাতিব মুর্তজা আলীর দল। বাংলাদেশের এই দুই বিতার্কিক ‘ইংলিশ এজ সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ ক্যাটাগরির মূল পর্বে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন এবং বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত এই বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হন। তাঁদের এই সাফল্য শুধু তাঁদের না, পুরো দেশবাসীর।

তর্কবাগীশ হতে চাইলে-

কথায় আছে, যেই মুলোটা বাড়ে তা পত্তনেই বোঝা যায়। তাই ছোটবেলা থেকেই স্কুলপর্যায়ে যেসব বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় সেগুলোতে অংশগ্রহণ করতে হবে। বিতর্কে অংশগ্রহণের জন্য অনেক বিষয় সম্পর্কে প্রচুর পড়ালেখা করতে হয়। আর যেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হবে তা সম্পর্কে ভালোভাবে না জানলে প্রতিপক্ষের সাথে সমান তালে তর্ক করা যাবে না। তাই ওই নির্দিস্ট বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি আরও ব্যাপক হতে হয়।

আশেপাশে কোথায় কি ঘটছে প্রতিনিয়ত এই ব্যাপারে জানতে হলে অবশ্যই প্রতিদিন সবাদপত্র ও খবর দেখার অভ্যাস করতে হবে। এছাড়াও এখন বাজারে অনেক বই পাওয়া যায় সাধারণ জ্ঞানের। এগুলো পড়লে সহজেই জানা যাবে দেশ ও বিদেশে কখন কি হচ্ছে, কবে কোন আইন টি পাশ হয়েছে, কার সাথে কি চুক্তি হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে। যা একজন তার্কিকের বিতর্কের জন্য অবশ্যই জানা থাকা জরুরি।

এখন আসা যাক বিতর্ক প্রতিযোগিতার আপনি কিভাবে যুক্তি তর্ক খণ্ডাবেন, কোন কোন ব্যাপার মেনে চললে আপনার পারফরমেন্স ভালো হবে সেই বিষয়ে-

*মানুষ খুব বিপজ্জনক হয় যখন তারা সিরিয়াস ব্যাপারে আলোচনায় বসে। অবশ্যই আপনার বিপক্ষে যে থাকবে সে আপনার প্রতিটা কথা নোট করে পাল্টা জবাব খুঁজবে। আর বিচারকদের খুশি করা তো প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই আপনাকে সাধারণ কিছু পদ্ধতি মাথায় রাখতে হবে।

*বিতর্কের শুরুতেই বিতর্কের বিষয়ে সংজ্ঞা দিতে হবে। তারপর কোন কোটেশন, কবিতার দুটি লাইন বা এমন কিছু উল্লেখ করুন যা আপনার বিতর্কের বিষয়ের সাথে যায়।

*গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে, দর্শক ও বিচারকদের দিকে তাকিয়ে কনফিডেন্টলি আপনার বক্তব্য শুরু করুন। বক্তব্যের শুরুতে আমম...উউউ...এরকম করবেন না।

*বিতর্ক শুরুর ভূমিকাটা বেশি বড় করবেন না। সরাসরি যেই বিষয়ে বিতর্ক সেই পয়েন্টে চলে আসুন। যদি বিতর্কের বিষয় কোন সমস্যা সম্পর্কিত হয় যেমন- ‘বাংলাদেশের যানজট সমস্যা’ তাহলে এই সমস্যার কারণে কোন কোন দিকে সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং এই সমস্যা নিরসনের উপায় নিয়ে বলবেন।

*অবশ্যই উদাহরণ থাকতে হবে আপনার বক্তব্যের মধ্যে। যদি আপনি সমস্যার সমাধান বলতে যান তাহলে আপনাকে সমস্যা অনুযায়ী উদাহরণ, সমীক্ষা ও বিশেষজ্ঞের মত উল্লেখ করতে হবে।

*অপরপক্ষের তার্কিক কি বলেছে সেগুলো লাইন আপ করে রাখবেন বা লিখে রাখবেন এবং এর বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে বোঝাবেন উনার দেখার দিকটা বা সমাধানের উপায়*টা ভুল ছিল, আপনারটা নয়।

*এটা মনে রাখবেন যে যত গুরুগম্ভীর বিষয়ই হোক না কেন, আপনার উপস্থাপনার উপরই দর্শকদের দৃষ্টি থাকবে। তাই যুক্তিতর্কের সময় আপনার উপস্থাপনা ও বচনভঙ্গি যেন সাবলীল কিন্তু জোরালো হয়।

*সবসময় আইকন্টাক্ট মেনে চলবেন। বিশেষ করে বিজ্ঞ বিচারকমণ্ডলীর উপর চোখ রেখে কথা বলবেন। এছাড়াও উপস্থিত দর্শকদের দিকে তাকিয়েও কথা বলবেন। এতে করে আপনার বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।

*সবশেষে আপনার বক্তব্য শেষ করার সময় পুরো বিষয়বস্তুটি আবার সংক্ষিপ্ত আকারে বলুন, বিশেষ বিশেষ পয়েন্টগুলো তুলে ধরুন এবং সমস্যা সমাধানের উপায় বলুন। শেষ করার আগে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে আপনার বক্তব্য শেষ করুন।

বিতর্কটাকে মজা নিয়ে উপভোগ করুন। কখনোই বেশি মানুষ দেখে নার্ভাস হয়ে যাবেন না বা স্ট্রেস নেবেন না। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীকে শত্রু ভাবার কোন কারণ নেই। স্টেজের বাইরে এরাই হতে পারে ভালো বন্ধু। নতুন মানুষের সাথে মিশতে পারছেন, নতুন নুতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারছেন, আপনার অভিজ্ঞতা বাড়ছে এসব ভেবে বিতর্ককে ইতিবাচক ও শিক্ষণীয় ভাবুন।

ধর্ম ও মানবসভ্যতা



বিতর্ক কেন করি? এই প্রশ্নের জবাবে মোটামুটি সব বিতার্কিক একটি কথাই বলবেন- আমরা যুক্তি দিয়ে সত্যকে বিচার করতে চাই। আমরা কুসংস্কার ও অজ্ঞতার ঊর্ধ্বে প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে নিজেদের দাবি করি। আর তাই যৌক্তিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে সত্যকে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখার প্রয়াস করি। অথচ সভ্যতার শুরু থেকে আজ অবধি সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় ধর্ম নিয়ে সদা তর্কে লিপ্ত হলেও দেশের বিতর্কের মঞ্চে বিতর্ক করতে খুব বেশি দেখা যায়না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে বলে কিংবা হয়তো ধর্মীয় ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি জ্ঞান না থাকার কারনে আয়োজক ও বিতার্কিক উভয়েই বিতর্কে ধর্মের প্রসঙ্গ সচেতনভাবে এড়িয়ে চলেন। যদিও বা কখনও ধর্ম নিয়ে বিতর্কের বিষয় নির্ধারন করা হয়, তখন সংজ্ঞায়নের বেড়াজালে ফেলে ধর্মের নেতিবাচকতা নিয়ে কথা না বলার সুকৌশল অবলম্বন করা হয়। অবস্থা দেখে মনে হয়, ধর্ম নিয়ে বিতর্ক করলে যেন জাত চলে যাবে। তবে এটাও ঠিক যে, ধর্ম সম্পর্কে খুব অল্প জ্ঞান নিয়ে বিতর্ক করার চেয়ে এড়িয়ে চলা উত্তম। মানব সভ্যতা ও ধর্মীয় ইতিহাস নিয়ে আমার সীমিত পড়াশুনার ফলে অর্জিত কিছু তথ্য জানানোর জন্যে এই উদ্যোগ, যেন নতুন বিতার্কিকরা ভবিষ্যতে ধর্ম নিয়ে বিতর্ক করতে তথ্যাভাবে অস্বস্তিবোধ না করেন, ধর্মকে ছোট করার জন্যে কিংবা নাস্তিকতাবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে নয়।

ছোটবেলায় সমাজবিজ্ঞান বইয়ের সুবাদে আমরা সবাই জানি যে, আজ থেকে প্রায় ১৪০০০ বছর আগে “মনু” বা “মনা”- অর্থাৎ অতিপ্রাকৃত শক্তির ধারনা থেকে মুলত ধর্মের উদ্ভব। যদিও আব্রাহামীয়(Abraham/ইব্রাহীম(আঃ)এর উত্তরসূরি) ধর্মত্রয়(ইহুদীবাদ, খ্রিস্টবাদ ও ইসলাম) মতে প্রায় ৬৫০০ বছর আগ থেকে ধর্ম ও মানুষের উদ্ভব(আদমকে প্রথম মানুষ মনে করে), তবে বিভিন্ন সভ্যতায় মানুষের উদ্ভব সম্পর্কে ভিন্নমত লক্ষ্যনীয়-যেমন, গ্রীক ও রোমান সভ্যতায় ২৫৮৬৮ খ্রিস্টপূর্বে, মিশরীয় সভ্যতায় ২৮০০০ খ্রিস্টপূর্বে (দেবতাদের ১১৯৮৪ বছর, উপদেবতাদের ২৬৪৬ বছর ও মানুষের ১৭৬৮০ বছর), সুমেরীয় ও ব্যবীলননীয় সভ্যতায় ৪০০০০০ খ্রিস্টপূর্বে, চীনা সভ্যতায় ৩৬০০০ খ্রিস্টপূর্বে মানব সৃষ্টির ধারনা পাওয়া যায়। এছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান আদিম মানুষের ফসিল দিয়ে প্রায় দেড় লাখ বছর পূর্বে মানুষের অস্তিত্ব প্রমান করেছে। তবে ঐতিহাসিকরা অন্তত এই বিষয়ে একমত যে, সভ্যতার শুরুর দিকের দেবীপ্রধান বহুঈশ্বরবাদের ধারনা ছিল মূলত মানুষের দুর্বলতা ও অজানার প্রতি ভয় থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ও মাতা প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। রাহুল সংকৃত্যায়নের “ভোলগা থেকে গঙ্গা” থেকে আমরা দেখতে পাই যে, আদিম যাযাবর জাতিগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাকে বলা হত “মনা”-যার ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তি ছিল বলে মনে করা হত। যদিও তৎকালীন সমাজব্যবস্থা মাতৃপ্রধান ছিল কিন্তু ক্রমান্বয়ে এই যোদ্ধারা যেহেতু সমাজের নিরাপত্তা তাদের হাতে ছিল, যাযাবর সমাজের নিয়ন্ত্রন নিজেদের কাছে নিয়ে নেয়। ধারনা করা হয়, কালের পরিক্রমায় এভাবেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আবির্ভাব ঘটে। আর প্যাগান দেবীদের হটিয়ে দেবতারা রাজত্ব শুরু করেন। সুমেরীয় সভ্যতার ইনানা, ব্যবীলনীয় সভ্যতার ইশথার, কানান(বর্তমান ইসরায়েল) সভ্যতার আনাত, মিশরীয় সভ্যতার আইসিস কিংবা গ্রীক সভ্যতার এপ্রোদিত দেবীদের তুলনায় এল, আমুন, রা, ক্যাওস, তিয়ামাত, আপসু, এপোলো, প্রমিথিউস, জিউস, পোসাইডন ও হেইডিসরা মানুষের কাছে অধিক পূজনীয় হয়ে উঠেন। আর পৃথিবীতে তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন রাজা বা ভূপতিরা। অনেক ইতিহাস বিশারদ মনে করেন যে, শাসন কার্যের সুবিধার জন্য এবং শাসিত শ্রেণীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রাচীন সমাজের অধিপতিরা ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। মিশরীয় সভ্যতার ফেরাউনরা যার উৎকৃষ্ট প্রমান। যারা জাদুর দেবী আইসিস এর উত্তরসূরি হিসেবে নিজেদের প্রচার করত। যদিও তারা আমুন ও রা এর মত পুরুষ দেবতাদের উপসনা করত। একই ভাবে ভারতীয় উপমহাদেশেও আমরা ধর্মের পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাব দেখতে পাই। সনাতন ধর্মের প্রথম দিকে দেবীদের উপসনা করা হত এবং সমাজে কোন শ্রেনীভেদ ছিলনা। কিন্তু এর পরিবর্তন ঘটে যখন খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ শতকের দিকে আর্য্যরা ইরান থেকে ইন্দো উপত্যকায় নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়, যা ঋগবেদে উল্লেখ আছে। রাহুল সংকৃত্যায়নের মতে, আর্য্যরাই প্রথম শ্রেণীপ্রথা(ব্রাক্ষ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) চালু করে এবং মানুষকে ত্যাগে উদ্ভুদ্ব করতে পুনর্জন্মের ধারনার প্রচার ঘটায়। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, বাংলাদেশ ও কলকাতায় যেভাবে দূর্গা, লক্ষী, স্বরস্বতী, কালী দেবীদের পূজা হয়, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ঠিক তার বিপরীতভাবে গণেষ, হনুমান, শিব, কার্তিক দেবতাদের পূজা হয়। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশ ও কলকাতার এই অঞ্চলে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থার ফলে মূলত এই পার্থক্য। যেমনটা আজও গারো উপজাতিদের মধ্যে বিদ্যমান। তবে ধর্মে পুরুষতান্ত্রিকতা আরও ব্যাপকতা লাভ করে একেশ্বরবাদ তথা আব্রাহামীয় ধর্মের বিকাশের পরে। বিশেষ করে ১৪৮০ থেকে ১৭৫০ সাল পর্যন্ত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ডাইনী শিকার(Witch Hunt) এর নামে যখন ৪০০০০ থেকে ৬০০০০ নারীকে চার্চের নির্দেষে হত্যা করা, তখন ধর্মে পুরুষদের নিয়ন্ত্রনের যুক্তি আরো জোরালো হয়।

ঐতিহাসিকদের মতে সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে গৃহীত একেশ্বরবাদ প্রচার করেন তেরাহ(Terah/আযার) এর পুত্র আব্রাহাম (Abraham/ইব্রাহীম(আঃ))। বাইবেলের জেনেসিস মতে, ১৮৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি ও তার জাতি মেসোপটেমিয়ার হারান(পশ্চিম তুরস্ক) থেকে ভূমধ্যসাগরীয় কানান অঞ্চলে আসেন এবং ‘ইয়াহওয়েহ’ বা ‘এলহিম’ এর ধর্ম প্রচার করেন। আব্রাহাম ফেরাউনদের হাত থেকে রক্ষার জন্য তার সৎবোন সারাহকে বিয়ে করেন এবং তার ১০০ বছর বয়সে আইজ্যাক (Isaac/ইসহাক(আঃ))জন্মলাভ করেন। আমরা কোরবানীর ইতিহাসে ইব্রাহীম (আঃ) এর তার প্রিয় পুত্র ইসহাক(আঃ) এর ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত আছি। আইজ্যাক পরবর্তীতে কানানের (বর্তমান ইসরায়েল) পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন করেন। তার পুত্র জ্যাকব(Jacob/ইয়াকুব), যিনি ইতিহাসে ইসরাঈল নামে পরিচিত এবং তার ১২ পুত্রের সম্মিলিত জাতিগোষ্ঠীকে ‘বনী ইসরাঈল’ জাতি বলা হয়। ইসরাঈলীরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মনে করত এবং তাদের ঈশ্বর ‘ইয়াহওয়েহ’ কে সকল দেবতার ঊর্ধ্বে স্থাপন করত। আর ‘ইয়াহওয়েহ’ এর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তারা মিশরে প্লেগের বিস্তার ও নীলনদের মহাস্রোতে ফেরাউন ও তাদের দেবতাদের পতনকে চিহ্নিত করে। তবে মিশর থেকে ফেরাউনদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে(কিংবা শাস্তি দিয়ে) যখন জ্যাকবের উত্তরসূরি মূসা(আঃ)(Moses) ও তার দল ইসরায়েলে আসেন, তখন থেকে সমগ্র ইসরায়েল এক ঈশ্বর ও ধর্মীয় চেতনায় আবদ্ধ হয়। আর তার নাম হয় “ইহুদীবাদ”। তবে ইহুদী শব্দের উত্থান মূলত জ়্যাকবের ৪র্থ পুত্র ইয়াহুদ(Judah/Yudah/Yahudh) থেকে। পরবর্তীতে ইয়াহুদ, লেভি, বেঞ্জামিন ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠিকে সম্মিলিতভাবে ইহুদী বলা হত। ইহুদীদের বিশ্বাস ছিল তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জাতি এবং ‘ইয়াহওয়েহ’ তাদের পবিত্র পূণ্যভূমি ইসরায়েল এর রক্ষাকর্তা। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ এর দিকে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে একটি স্বতন্ত্র জাতি গড়ে ওঠে। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের দিকে বিস্তৃত রোমান সাম্রাজ্যের কাছে ৬ খ্রিস্টাব্দে পরাজিত হয়ে ইসরায়েলীরা জেরুজালেমের কর্তৃত্ব হারায়। আর রোমান সম্রাট আদ্রিয়ান(Hadrian) ১৩৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানী জেরুজালেমের নাম পরিবর্তন করে রাখেন এলিয়ে ক্যাপিতলিনা(Aelia Capitolina) এবং জুডিয়া(Judea) অঙ্গরাজ্যের নাম পরিবর্তন করে রাখেন সিরিয়া প্যালেস্তাইন(Syaria Palestine)। পরবর্তীতে ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিন-I পুনরায় জেরুজালেম নামকরন করেন।

বনী ইসরাঈল জাতিতে পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ নবী আসেন ডেভিড(David/দাঊদ(আঃ))ও সুলেমান(Solomon/সুলায়মান(আঃ)) এর উত্তরসূরি কুমারী মাতা ম্যারী এর পুত্র যীশু(Jesus/ঈসা(আঃ)-খ্রিস্টপূর্ব ৭-২ সন থেকে ৩০-৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত)। ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম উভয়েই মনে করেন ঈশ্বরের অতিপ্রাকৃত শক্তির কৃপায় কুমারী ম্যারীর গর্ভে যীশুর আবির্ভাব। তবে অনেক ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ঐতিহাসিক মনে করেন যে, মিশরীয় জাদুর দেবী কুমারী আইসিস ও তার পুত্র হোরাসের জনপ্রিয় কাহিনী থেকেই ম্যারী ও যীশুর কাহিনীকে ধারন করা হয়েছে। যীশু জেরুজালেমে তার মতবাদ প্রচার করতে থাকেন, কিন্তু ইহুদীরা তাকে অধর্ম প্রচারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং রোমান গভর্নর পন্থিয়াস পিলাত (Pontius Pilate) তাকে ক্রুসে বিদ্ধ করার নির্দেষ দেন। যীশুর মৃত্যর পর(কিংবা পুনরুত্থানের পর) তার অনুসারীরা তার মতাদর্শের প্রচার শুরু করেন এবং যা শুরুর দিকে একেশ্বরবাদের ধারনা হিসেবে প্রচারিত হলেও পরবর্তীতে ত্রয়ীবাদ(Trinity-Father, Son & Holly Spirit) হিসেবে ৩২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে রোমান চার্চ প্রচার শুরু করে। যদিও ত্রয়ীবাদ নিয়ে রোমান ক্যাথলিক, অর্থোডক্স ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে বিরোধ বিদ্যমান, তবে সবাই এ বিষয়ে একমত যে, চার্চের কর্তৃত্ব(পোপ, বিশপ, ক্লার্জি) থাকবে পুরুষদের হাতে। মূলত চার্চের হাতেই ধর্মে পুরুষতান্ত্রিকতা ব্যাপকতা লাভ করে বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, যা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মেও লক্ষ্যনীয়।

বনী ইসরাঈল জাতির শেষ নবী হলেন আব্রাহামের ত্যায্যপুত্র(ইহুদী ও খ্রিস্টধর্মমতে) ইসমাঈল এর বংশধর মুহম্মদ(সাঃ)-জন্মসূত্রে প্যাগান, (৫৭০ খ্রিস্টাব্দ-৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) । তিনিও অন্যান্য প্রধান নবীদের মত ৪০ বছর বয়সে(!) নবুয়্যত প্রাপ্ত হন এবং ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু করেন। যদিও প্রথমে অন্যান্য আব্রাহামীয় ধর্মের মত ৬২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে জেরুজালেমকে পবিত্র ভূমি হিসেবে মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্র(ক্বিবলা) হিসেবে গণ্য করা হত, পরবর্তীতে ৬২০ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদের মিরাজের পরে তা মক্কার ক্বাবাতে পরিবর্তিত হয়। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, বনী ইসরাঈল জাতিকে ধর্মান্তরিত করতে ব্যর্থ হয়ে এবং ইব্রাহীম ও তার পুত্র ইসমাঈল এর ক্বাবা শরীফ পুনঃনির্মানের কাহিনীতে উদ্ভুদ্ব হয়ে পরবর্তীতে মক্কাকে মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্র নির্ধারন করা হয়। যদিও জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ মুসলিম বিশ্বের প্রধান ৩টি মসজিদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়। মূলত খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের আবির্ভাব বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় সংঘাতকে প্রভাবিত করে। কেননা এতদিন ধরে চলে আসা সনাতন ও ইহুদী ধর্মের অনুসারীরা যথাক্রমে আর্য ও বনী ইসরাঈল জাতি হিসেবে নিজেদের শ্রেষ্ঠতম জাতি মনে করত এবং এজন্যেই অন্য ধর্ম থেকে এই দুটি ধর্মে অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম উভয় ধর্মই ধর্মান্তরকে প্রাধান্য দেয় এবং এই দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় যে, তাদের ধর্মই সমগ্র মানব জাতির জন্য। মূলত খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম ধর্মের এই দ্বান্দ্বিক অবস্থাই বিশ্বব্যাপী আন্তঃধর্মীয় সংঘাতের জন্ম দেয়, যা আজও বিদ্যমান।

খ্রিস্ট ধর্মের ব্যাপক বিস্তৃতির ফলে রোমান সম্রাট কনস্টান্টিন-I প্যাগান থেকে খ্রিস্টান হন এবং পুরো রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্ট ধর্মকে বৈধতা প্রদান করেন। ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে ইহুদীদের জেরুজালেমে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়, শুধুমাত্র বছরে একবার প্রার্থনার কারন ছাড়া। ৩২৬ থেকে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চার্চ ধর্ম প্রচারের নামে সকল প্যাগান দেব-দেবীর মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে এবং খ্রিস্ট ধর্মের ব্যাপক প্রচার চালায়। ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ওমর ইয়ারমুকের যুদ্ধে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটান এবং জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রন নেন। মুহম্মদ ইবনে জারীর আল তারাবী’র মতে, খলিফা ওমর ও পাট্রিয়ার্ক সাফ্রোনিয়াস ঐকমত্যে পৌছান যে, জেরুজালেমে খ্রিস্টানরা স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে কিন্তু ইহুদীদের নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। ইহুদীদের প্রার্থনার জায়গা Temple Mount এর পবিত্র পাথর (Dome of Rock) কে মসজিদ-উল-মুকাদ্দাস এ রুপান্তর করা হয়, কেননা মুসলমানরা মনে করেন যে, এখান থেকেই মুহম্মদ মিরাজ যাত্রা আরম্ভ করেন। ৬৩৬ থেকে ৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জেরুজালেম, মিশর, সিরিয়া ও তুরস্কে রাশেদীন, উমায়্যাদ ও আব্বাসীদ খিলাফত বহাল থাকে। ৯৬৯ থেকে ১০৯৮ পর্যন্ত ছিল ফাতিমিদ খিলাফতের সময়কাল। এই সময়ের মধ্যে ইসলামী সাম্রাজ্য ব্যাপক বিস্তার লাভ করে, কিন্তু একই সাথে চার্চের সাথেও বিরোধ বাড়তে থাকে।

ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের সবচেয়ে বড় বিরোধ বাধে জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রন নিয়ে, আর ইতিহাসে যাকে ‘ক্রুসেড’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। ১০৯৫ সনে পোপ আরবান-II বাইযেন্টাইন সম্রাট আলেক্সিস কোমনেনস এর আবেদনে সাড়া দিয়ে পবিত্র ভূমি জেরুজালেমকে মুসলিম সাম্রাজ্যের হাত থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য ‘প্রথম ক্রুসেড’এর ডাক দেন। ‘Just War’ তত্ব মূলত ক্রুসেডকে গ্রহনযোগ্যতা দেয়ার জন্য তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন। ১২০০০০ ফ্র্যাঙ্ক(ফ্রেঞ্চভাষী পশ্চিমা খ্রিস্টান) ক্রুসেডে অংশ নেয় এবং ১০৯৯ সনে চার্চ জেরুজালেমের দখল নেয়। তারা মসজিদ-উল-মুকাদ্দাসকে চার্চে রুপান্তর করে। ১০৯৯ থেকে ১১৩৭ পর্যন্ত জেরুজালেম চার্চের অধীনে থাকে। তারা জেরুজালেম, এডেসা, এন্টিওক ও ত্রিপলী এই ৪ ভাগে ক্রুসেড রাজ্যকে ভাগ করে। যদিও তারা লেবাননের নিয়ন্ত্রন নেয়ারও চেষ্টা করে, কিন্তু দামেস্কের শাসক জহির আলদীন আতাবেকের কাছে পরাজিত হয়। ১১৩৭ সালে ইমাদ আদ্দীন জেঙ্গী এডেসা দখল করে। আর পুনরায় চার্চের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার জন্য ১১৪৭-১১৪৯ পর্যন্ত ‘দ্বিতীয় ক্রুসেড’ পরিচালিত হয়। ফরাসী রাজা লুইস-VII ও পশ্চিম জার্মানীর রাজা কনরাড-III ১১৪৭ এ এডেসার উদ্দেশ্যে তার সেনাবাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন, কিন্তু জেঙ্গীর কাছে পরাজিত হয়। তবে এডেসায় ব্যর্থ তারা পর্তুগালের রাজা আফনসো-I এর সাথে যৌথভাবে আক্রমন করে মুসলিমদের কাছ থেকে লিসবন দখল করে নেয়। তবে ক্রমান্বয়ে মুসলিম সাম্রাজ্য শক্তিশালী হতে থাকে এবং ১১৮৭ সনে হাত্তিন(Battle of the Horns of Hattin) এর যুদ্ধে সালাউদ্দীন ইউসুফ ইবনে আইউব চার্চের কাছ থেকে পুনরায় জেরুজালেমের দখল নেয়। তিনি ইহুদী ও অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের সাথে সমঝোতায় আসেন এবং মসজিদ-উল-মুকাদ্দাস পুনরাস্থাপন করেন। ১১৯২ সনে ‘সিংহহৃদয়’ রিচার্ড এর নেতৃত্বে ‘তৃতীয় ক্রুসেড’ পরিচালিত হয়, কিন্তু তারা জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হন। তবে রিচার্ড ও সালাউদ্দিন রামলা চুক্তির মাধ্যমে পশ্চিমা খ্রিস্টানদের জেরুজালেমে স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার সুযোগ দেন। কিন্তু চার্চ থেমে থাকেনি। ১২৭২ সাল পর্যন্ত পবিত্র ভূমি পুনরুদ্ধারের নামে সর্বমোট ৯টি ক্রুসেড সংঘঠিত হয়। আর ধর্মের নামে লক্ষাধিক মুসলমান ও ইহুদী হত্যা করা হয়। তবে প্রায় সবকটি ক্রুসেডে পরাজিত হয় চার্চ। পরবর্তীতে ১৩০০ সালে মোঙ্গলীয়রা আর ১৩৮২ সালে মামলূক সাম্রাজ্য জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রন নেয়। তবে পূণ্যভূমির নিয়ন্ত্রনের যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়। ১৫১৬ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের(Turkish Empire) সুলতান সেলিম, আলেপ্পো ও গাজা’র যুদ্ধে জেরুজালেমে মামলূক সাম্রাজ্যের পতন ঘটান। ১৭৯৯ সালে নেপলিয়ন বেনাপোর্ড মিশর ও সিরিয়ার মাধ্যমে জেরুজালেম দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে(১৯১৭ সালে), বৃটিশ সেনাবাহিনীর কাছে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। আর ১৯২৪ সাল থেকে শুরু হয় জিওনিস্ট বিদ্রোহ(Zionist Revolution), যা ছিল মূলত ইসরায়েল রাষ্ট্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সংঘবদ্ধ ইহুদী আন্দোলন। তবে ১৯৩৩ সালে যখন হিটলারের নাৎসী বাহিনী ক্ষমতায় আসেন, ইহুদীদের নিশ্চিহ্ন করতে ১৯৪৫ পর্যন্ত চলে নৃসংশতম হত্যাকান্ড যা ইতিহাসে ‘হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত। এই হত্যাকান্ডে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ইহুদীকে হত্যা করা হয়। ইহুদীদের হত্যার পিছনে অনেক ঐতিহাসিক হিটলারের ধর্মীয় অহংবোধকে দায়ী করেন। ধারনা করা করা, ইসরাঈলীদের মত হিটলারও ইন্দো-আর্য জাতিকে(যার একটি ধারা পশ্চিম জার্মানীরা) শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বিশ্বাস করতেন এবং যার কারনে নাৎসী বাহিনীর প্রতীক ‘সোয়াস্ত্রিকা’-হিন্দুদের(আর্যদের) থেকে অনুপ্রানিত। এছাড়া ইহুদীদের প্রতি রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিদ্বেষ্পূর্ণ মনোভাবও তাকে প্রভাবিত করেছে বলে অনেকে মনে করেন। নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের জন্য হিটলার হয়তো ইহুদীদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ফেলতেন যদি না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর কাছে তার পরাজয় না ঘটত। আর দীর্ঘদিনের জিওনিস্ট বিদ্রোহের পর জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ১৯৪৭ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের পুনর্জন্ম মূলত বনী ইসরাঈল জাতিকে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিশ্রুত পবিত্র ভূমিতে ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে অনেকে এও মনে করেন যে, ইসরায়েল কখনই শুধুমাত্র বনী ইসরাঈল জাতির ছিলনা। জেরুজালেমে ঐতিহাসিকভাবে ইহুদী, খ্রিস্টান ও পরবর্তীতে মুসলমান, সবারই সহাবস্থান লক্ষ্যনীয়। তাই ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম অনেকেই জাতিসংঘের পক্ষপাতিত্ব বলে মনে করেন। কিংবা অনেকে মনে করেন যে, আপাত দৃষ্টিতে এটি ধর্ম যুদ্ধের অবসান ঘটালেও এটি ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম সাম্রাজ্যের উপর নিয়ন্ত্রনের জন্য পশ্চিমা শক্তির এক ষড়যন্ত্র। আর এই বর্তমান সময়ে অনেকেই উক্ত ধারনার সত্যতা দেখতে পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দুটি জিনিসের সমাপ্তি ঘটে-১.ধর্মীয় যুদ্ধ ও ২.সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার। তবে এরপরেও যে, ধর্ম নিয়ে সংঘাত হয়নি তা নয়। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব, ইরাকের শিয়া-সুন্নী সংঘাত, রুয়ান্ডার হুতো-তুতসী সংঘাত, গুজরাটের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, চেচনীয়া-বসনিয়া সংঘাত, তিব্বত-চীন দ্বন্দ্ব কিংবা অতি সাম্প্রতিক মায়ানমারের রোহিঙ্গা-বৌদ্ধ দাঙ্গা ইত্যাদি বিভিন্ন সংঘাত আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় ধর্মের নামে এখন পর্যন্ত কত নির্দোষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আর খুব দ্রুতই যে, এর থেকে পরিত্রান পাওয়া যাবে-সে ব্যাপারেও অনেকে সন্দিহান। তাদেরই একজন সমাজবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন।

স্নায়ু যুদ্ধের শেষে অনেকের মত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা মনে করেন যে, বিশ্ব ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে পৌছেচে। তিনি ১৯৯২ সালে তার ‘The End of History and the Last Man’ বইয়ে জার্মান দার্শনিক হেগেলের তত্ত্ব দিয়ে সভ্যতার সংঘাতের সম্ভাবনাকে নাকোচ করে দেন। তবে হান্টিংটন ফুকুয়ামার সাথে একমত হতে পারননি। ১৯৯৩ সালে তিনি ‘সভ্যতার সংঘাত’ (Clash of the Civilization) তত্ত্ব প্রকাশ করেন। হান্টিংটন মনে করেন যে, অধিবিদ্যার(Ideology) যুগের সমাপ্তি ঘটলেও সভ্যতার সংঘাতের সমাপ্তি ঘটেনি। তিনি মনে করেন যে, আগামীর বিশ্ব মূলত সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সংঘাতে লিপ্ত হবে। আর এই সংঘাত সংগঠিত হবে মূলত পশ্চিম ও মুসলিম সভ্যতার মধ্যে। রাশিয়া, জাপান ও ভারতকে তিনি Swing Civilization নাম দেন, কেননা তারা যেকোন পক্ষকে সমর্থন করতে পারে। উদাহরনস্বরূপ, রাশিয়া তার দক্ষিণ সীমান্তের মুসলিমদের(চেচনিয়া) সাথে সংঘাতে জড়ালেও অপরদিকে ইরানের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করছে ভবিষ্যত মুসলিম-অর্থোডক্স সংঘাত এড়াতে এবং তেলের প্রবাহ নিশ্চিত করতে। এছাড়া মুসলিম-চীন সম্পর্ক, বিশেষ করে ইরান, পাকিস্তান, সিরিয়ার মত দেশের সাথে চীনের সম্পর্ক এক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। হান্টিংটন মনে করেন যে, ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা খ্রিস্টান-মুসলিম দ্বন্দ্ব এবং বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তার ও পশ্চিমা সমাজে মুসলিমদের উপর নেতিবাচক আচরন অনেক ক্ষেত্রে মৌলবাদের উত্থান ঘটাতে পারে এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে ধাবিত করতে পারে। তিনি সভ্যতার দ্বন্দ্বের ৬টি মৌলিক কারন আলোচনা করেন। যেগুলো হলঃ-

১. শতবছর ধরে ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রথা ও ধর্মের কারনে সৃষ্ট যে সভ্যতার ভেদাভেদ, তা খুব দ্রুত অবসান হবেনা।
২. ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসা পৃথিবীতে সাংস্কৃতিক মিথষ্ক্রিয়ার ফলে প্রতিটি সভ্যতা তার স্বকীয়তা নিয়ে অধিক সচেতন হবে।
৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে যখন মানুষ তার নিজস্বতা হারিয়ে বিশ্বমানব হয়ে উঠছে তখন ধর্ম মানুষকে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় ও জাতিস্বত্ত্বার পরিচয় দিয়েছে।
৪. একদিকে পশ্চিমা সভ্যতা যেখানে ক্ষমতার শীর্ষে, অন্যদিকে বাকি সভ্যতাগুলো চাইছে মূলে ফিরে যেতে। প্রাচ্য ও পশ্চিমের এই দ্বিমুখী অবস্থান সভ্যতার সংঘাতকে প্রভাবিত করতে পারে।
৫. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো যত দ্রুত সমাধান করা সম্ভব, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র ও পার্থক্য নিয়ে সমঝোতায় আসা ততই দুরূহ।
৬. আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সভ্যতার সচেতনাকে প্রভাবিত করবে।

হান্টিংটন মনে করেন যে, আন্তঃসভ্যতা দ্বন্দ্ব মূলত দুইভাবে সংঘটিত হবে-১.ফল্ট লাইন সংঘাত ২.কোর লাইন সংঘাত। আর তাই সামরিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগ, অন্য সভ্যতার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরন, সভ্যতার আধিপত্য কিংবা একটি সভ্যতার বিশ্বাস ও মূল্যবোধ জোরপূর্বক অন্য সভ্যতার উপর চাপিয়ে দেয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কারনে সভ্যতার সংঘাত অনিবার্য। আর বর্তমান বিশ্বে পশ্চিমা সভ্যতার আধিপত্য এবং মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরন- হান্টিংটনের ধারনাকে আরও শক্ত করে। তবে অনেকেই আছেন যারা হান্টিংটনের মতবাদের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলেন। অমর্ত্য সেন(১৯৯৯) মনে করেন যে, “পশ্চিমা সভ্যতাসহ সকল সভ্যতারই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র রয়েছে। তবে তা স্বত্ত্বেও বিংশ শতকে গনতন্ত্রের বিপ্লব শুধই পশ্চিমা ধারনা নয়, প্রাচ্যও এর সাথে একমত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনেক ইস্যুতে আজ সভ্যতারগুলোর মধ্যে খুব বেশি বিরোধ নেই”। হান্টিংটনের মতবাদের বিপরীত দুটি উল্লেখযোগ্য মতবাদ হল-১.ইরানের রাষ্ট্রপতি মুহাম্মাদ খাতামি’র ২০০১ সালের ‘সভ্যতার সংলাপ’ এবং ২০০৫ সালে জাতিসংঘের সাধারন সভায় উত্থাপিত স্পেনের রাষ্ট্রপতি, হোসে লুইস রদ্রিগুয়েজ ও তুরস্কের প্রধামন্ত্রী, তায়ীপ এর্দোগান এর সম্মিলিত মতাবাদ-‘সভ্যতার মৈত্রী’। উভয় মতবাদই ধারনা করে যে, মুসলিম ও পশ্চিমা সভ্যতার সাথে আলোচনা ও মতৈক্যের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি নিশ্চিত হবে।

মানব সভ্যতার শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত ধর্মের উদ্ভব, বিকাশ এবং এর সাথে জড়িয়ে থাকা সভ্যতাগুলোর আচরন আমাদের কতগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন করে- কেন মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিলোপ ধর্মে পুরুষদের প্রভাব বাড়িয়ে তোলে, কেন বিশ্বের প্রধান তিনটি ধর্মই আব্রাহামের জাতির দ্বারা প্রচারিত, কেন শাসক গোষ্ঠী নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ধর্মের ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে আর কেনই বা নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের জন্য অন্য ধর্মের নিরীহ মানুষদের নিজ ধর্মে রূপান্তর কিংবা হত্যা করতে হবে? চায়ের দোকানে কিংবা মেসের আড্ডায় অনেক তর্ক হয় এই বিষয়ে। কিন্তু একমাত্র বিতার্কিকরাই পারেন গঠনমূলক আলোচনা করতে। বিতর্কের জয় হোক।

তথ্যসূত্রঃ
১. উইকিপিডিয়া
২. ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’, রাহুল সংকৃত্যায়ন
৩. ‘The History of God’, Karen Armstrong
৪. ‘The Chariots of God’, Eric Von Daniken




The Descendents of Abraham
লেখক সানাউল হক হিমেল
সাবেক সভাপতি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ডিবেট ক্লাব

যুক্তিবাদী তারুণ্য গড়াই যার অঙ্গীকার



বিতর্ক একটি আলোময় ও বুদ্ধি উদ্ভাসিত জগত্। বিতর্ক মানুষের চেতনাকে জাগিয়ে তুলে, মনকে করে আলোড়িত ও শিহরিত, চিন্তা শক্তিকে করে উদ্দীপ্ত। আর এই উদ্দীপ্ত করার কাজটি নিষ্ঠার সাথে করে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা থেকে মফস্বল শহর তথা ইউনিয়ন পর্যায়ে বিতর্ক জগতের প্রিয় ব্যক্তিত্ব হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। আমাদের এবারের আয়োজনে উঠে এসেছেন প্রজন্মের এ আইকনের জীবনের কথামালা। তাকে নিয়ে লিখেছেন খালেদ আহমেদ

'আমি বিতর্ক নিয়ে বুকের গভীরে অন্য ধরনের এক স্বপ্ন অনুভব করি। এ কারণে যাপিতজীবনের অনেক কিছু তুচ্ছ করে বিতর্ক নিয়ে দৌড়াতে থাকি। এখানে এক অদ্ভুত ভালোলাগা এবং হূদয়গত টান আছে। আছে এক অপূর্ব মায়ার বন্ধন। বিতর্ক শিল্পের বিকাশে যে সময়টা দিই সেটা যদি ব্যবসা বা অন্যখাতে দিতাম তাহলে আর্থিকভাবে আরও লাভবান হওয়া আমার জন্য অসম্ভব কিছু ছিল না। কিন্তু মন টানে না, সে পথে সায় দেয় না। মনে হয় এই শিল্পটাই জীবনের সবকিছুর সাথে জড়িত আছে। স্বভাবতই বিতর্কটাকে ছাড়তে পারি না।' কথাগুলো বলছিলেন, হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। বিতর্ক সংগঠক হিসেবে যার জনপ্রিয়তা এখন আকাশ ছোঁয়া। বিতর্ক অনুষ্ঠান আয়োজন, পরিচালনা আর নির্মাণে রীতিমতো যিনি আইকনে পরিণত হয়েছেন। এককথায় বললে টেলিভিশন মিডিয়াতে বিতর্ককে জনপ্রিয় করার মূল কারিগর তিনিই। একের পর এক বিতর্ক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যে দিয়ে তিনি এই শিল্পের জনপ্রিয়তা এবং বিস্তার দুটোকে সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের উদ্যোগে দেশের আট হাজার মাধ্যমিক স্কুলের অংশগ্রহণে যে বিশাল বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় সেই 'বিতর্কবিকাশ' আয়োজনের অন্যতম কুশীলব ছিলেন তিনি। অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, সঞ্চালনা ও আয়োজনে অন্যতম ভূমিকা রাখেন। উল্লেখ্য ক'দিন আগে এই প্রতিযোগিতার গ্র্যান্ডফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় নগরীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। এটিএন বাংলা সরাসরি গ্র্যান্ড ফাইনাল অনুষ্ঠানটি প্রচার করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ এমপি। আরও উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ, এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান ড. মাহফুজুর রহমান, শিক্ষাসচিব আব্দুল কামাল নাসের চৌধুরীসহ আরও অনেকে। ওইদিন ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা এসে জড়ো হয়। সমাজের নানা শ্রেণীপেশার মানুষের উপস্থিতিতে গ্র্যান্ড ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। সবাইকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে গ্র্যান্ডফাইনালের শুভসূচনা করেন হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। তার চমত্কার এবং নিখুঁত উপস্থাপনায় দারুণ এক উপভোগ্য বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তি আর করতালিতে বিতর্কের এক অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে। আগত অতিথিরাও কিছুক্ষণের জন্যে বিতর্কে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। কিরণ বলছিলেন সেই কথা, 'দেখুন গ্রামবাংলার আট হাজার মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ রকম আয়োজন আর কখনোই হয়নি। আমি নিজেই প্রাণভরে এই বিতর্ক আয়োজন উপভোগ করেছি। এই আয়োজনের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে শহর নয়, গ্রামেও আমাদের সুপ্ত সুন্দর প্রতিভা রয়েছে যারা সুযোগ পেলেই আলো ছড়াতে সক্ষম।' কিরণ আরও বলেন, 'যে সব প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এখানে অংশগ্রহণ করে তাদের অনেকেই মৌলিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত। এমন অনেকে ছিল যারা একটা ভালো পোশাক পর্যন্ত পরতে পারে না। কিন্তু তারা স্বপ্ন দেখে সুন্দরভাবে বড় হওয়ার। স্বপ্ন দেখে সুন্দর একটি সমাজ নির্মাণের।' পুরো আয়োজনটা সুন্দরভাবে শেষ করার জন্য ব্র্যাককেই সব কৃতিত্ব দিতে চান কিরণ। তার মতে, ব্র্যাকের উদ্যোগ ও সুসমন্বয়, এটিএন বাংলার সহযোগিতা এবং ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির নিরবচ্ছিন্ন সম্পৃক্ততা 'বিতর্কবিকাশ' অনুষ্ঠানকে উচ্চমাত্রায় নিতে সক্ষম হয়। তিনি জানান, 'বিশেষ করে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি পরিচালক ড. শফিকুল ইসলামের সার্বিক সমন্বয় বছরব্যাপী আয়োজিত এই প্রতিযোগিতাকে আমরা আমাদের প্রত্যাশিত জায়গায় নিতে পেরেছি।'

বিতর্কবিকাশের চূড়ান্ত লড়াইটা তো বেশ জমে উঠেছিল? কিরণ বলেন, 'নিঃসন্দেহে। এই প্রতিযোগিতা শেষে অনেক দূরদূরান্ত থেকে ফোন পেয়েছি। অনেকে এসএমএস করে অভিনন্দন জানিয়েছে। ওইদিন দুটি দলের শিক্ষার্থীরাই খুব ভালো বিতর্ক করেছিল। তথ্য, উপাত্ত দিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের শিক্ষার্থীরা বিষয়টি দারুণ উপভোগ্য করে তুলেছিল। সঞ্চালক হিসেবে আমি নিজেও গ্র্যান্ড ফাইনালটাকে এনজয় করেছি। কিরণ বলেন, দেখুন যে দুটি দল ফাইনালে উঠেছিল সে দুটি দল একেবারেই গ্রাম পর্যায়ের স্কুল। অথচ এখানকার ক্ষুদে বিতার্কিকরা চমত্কার উপস্থাপনা দিয়ে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়। আসলে বিতর্ক বিকাশের আয়োজনটাই ছিল অন্য রকম। আমার জানামতে, দেশের এতগুলো স্কুল কখনোই একসাথে এত বড় কোনো বিতর্ক প্রতিযোগিতাতে অংশ নেয়নি। আমার মনে হয় দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেই এত বড় কোনো আয়োজন হয়নি। এ রকম একটি আয়োজনের অংশীদার হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হয়েছে। বিতর্ক বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান কোনো চ্যানেল সরাসরি দেখাতে পারে এটাও বোধ হয় আমরাই প্রথম প্রমাণ দিলাম। এটিএন বাংলার সুবাদে 'বিতর্কবিকাশ' অনুষ্ঠানটি লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী এবং দেশ-বিদেশের দর্শক টিভি সেটের সামনে বসে উপভোগ করেছে।'

বাংলাদেশে বিতর্ক চর্চাটাকে কীভাবে দেখতে চান জানতে চাইলে কিরণ বলেন, 'দেখুন, বিতর্ক চর্চার প্রসার বৃদ্ধিতে আমরা অনেক দিন ধরে নিরলসভাবে কাজ করছি। কিন্তু আমরা চাই বিতর্কচর্চাটা শিক্ষার মূলস্রোতে অর্ন্তভুক্ত হোক। এখন পর্যন্ত সেটা কিন্তু হয়নি। 'বিতর্কবিকাশ' অনুষ্ঠানের গ্র্যান্ড ফাইনালে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এসেছিলেন। আমরা কিন্তু তার কাছে কিছুই চাইনি। শুধু বলেছি কো-কারিকুলার হিসেবে বিতর্কটাকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। আমরা লক্ষ্য করছি এ বছরে পরিমার্জিত বা সংশোধিত পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহারিক এবং উন্নয়নমূলক অনেক ধরনের শিক্ষা যুক্ত করা হয়েছে। অথচ ব্যবহারিক শিক্ষার চেয়ে জরুরি বিষয় শিক্ষার্থীর ভেতরের বিকাশ। তার মনন ও চেতনার বিকাশ। তো সেই পটভূমি তৈরি করতে হলে তার চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ সম্পর্কে জানতে এবং বুঝতে হবে। নিজের মাঝে বিশ্লেষণ ও বিচারিক ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কারণ এখন তো গোটা বিশ্বেই প্রতিযোগিতার যুগ। তো এখানে বিতর্ক শিক্ষাটা একজন শিক্ষার্থীর মেধামনন বিকাশে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা মন্ত্রীকে সে কথাই বলেছি যে, আপনি পাঠ্যপুস্তকে বিতর্কটাকে অন্তর্ভুক্ত করুন। এটা করা হলে শিক্ষার্থীদের মাঝে এই চর্চাটা আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। মন্ত্রী মহোদয় আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে আগামী শিক্ষাবছরে বিতর্ককে পাঠ্যপুস্তকে অন্তুর্ভুক্ত হবে।'

বিতর্ক চর্চা, অনুশীলনকে কিরণ দেখেন সমাজের আয়না হিসেবে। কিরণ মনে করেন, সমাজে যেকোনো বিষয় নিয়ে যত বেশি বিতর্ক হবে তাতে করে সমাজ, রাষ্ট্রই বেশি লাভবান হবে বেশি। সমাজের সবক্ষেত্রে এক ধরনের জবাবদিহিতা উত্তরোত্তর বাড়বে। প্রথাগত চিন্তাভাবনা থেকে তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে। তরুণ প্রজন্মের মাঝে মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, সদিচ্ছা তৈরি হবে। কিরণ বলেন, সমাজে-রাষ্ট্র, কী হচ্ছে কেন হচ্ছে তা জানার অন্যতম মাধ্যম—বিতর্ক। যেখানে নানা মতের সম্মিলন ঘটে। যেখানে কবলই যুক্তি দিয়ে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। যেখানে আবেগের চেয়ে বাস্তবতার আলোকে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়ে থাকে। বিষয়গুলোকে কেবলই তথ্য-উপাত্ত দিয়ে গভীরভাবে তুলে ধরতে হয়। কিরণ দারুণভাবে বিশ্বাস করেন বিতর্ক চর্চার যত প্রসার ঘটবে তত দ্রুতই সমাজ, রাষ্ট্র বদলে যাবে। আর এই বদলানোর বড় কারিগর হচ্ছে তারুণরা। যারা এ দেশের আগামী দিনের সম্পদ। এ কারণেই তিনি বারবার তরুণদের কাছে ফিরে যান। তরুণদের সাথে প্রবীণদের ভাবনার চমত্কার সম্মিলন ঘটিয়ে সুচিন্তার ঐক্য গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। এ জন্য বিতর্কের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের বিষয় বিশেষজ্ঞদের সাথে তরুণদের সেতুবন্ধন তৈরি করেন। এ পর্যন্ত দেশের অসংখ্য বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের তরুণদের পাশে বসিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন তিনি।

তারুণ্যে যাদের সাথে কিরণ বিতর্ক চর্চা শুরু করেছিলেন তাদের অনেকেই এখন আর বিতর্ক জগতের কেউ নন। কেউ কেউ একটু-আধটু জড়িয়ে আছেন। কেউ কেউ আবার একেবারেই লাপাত্তা। কিন্তু কিরণ সেই যে পথচলা শুরু করেছিলেন আর থামেননি। এখনও পথ চলছেন। বিতর্ক চর্চা আর প্রসারটাই তার কাছে মুখ্য বিষয়। বিতর্ক নিয়ে দীর্ঘ পথচলায় তার কোনো ক্লান্তি নেই। কখনও সঞ্চালক, কখনও স্পিকার হিসেবে দর্শকদের শুভ সম্ভাষণ জানান তিনি। কখনও পর্দার আড়ালে থেকে চমত্কার সব আয়োজন তরুণদের সামনে উপস্থাপন করেন। বিতর্ক নিয়ে কেন এই দীর্ঘ পথচলা? কিরণের সহাস্য উত্তর, 'দেখুন, একটা কমিমেন্ট থেকে বিতর্ক চর্চাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বহুবার বলেছি এ দেশটাকে সুন্দরভাবে গড়তে হলে দায়িত্বশীল তরুণ দরকার। দেশপ্রেমিক তারুণ্য দরকার। যে তরুণরা বদলে দেবে আগামীদিন। আমি নিবিড়ভাবে বিশ্বাস করি যুক্তিশীল তারুণ্য গড়ে তুলতে পারলে আমাদের দেশ সামগ্রিকভাবে লাভবান হবে। আমরা বিতর্ক দিয়েই আলোকিত তরুণ সমাজ গড়ে তুলতে চাই। আর বিতর্ক চর্চাটাকে এগিয়ে নেওয়ার ব্রতে আমি কখনই পেছনে ফিরে তাকাইনি। বরাবরই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি নতুন ধারণায়, নতুন উদ্দীপনায় বিতর্কটাকে সবার সামনে হাজির করতে। বিতর্ক মানেই যুক্তির সাধনা। সাধনা মানেই যেটা অন্তরে ধারণ করা হয়। আমি বিষয়টিকে অন্তর দিয়েই ধারণ করি। আর এ কারণেই বিতর্কের সাথে আমার বন্ধন অবিচ্ছেদ্য।'

বিতর্কের সাথে কিরণের যেন এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন তৈরি হয়েছে। যে বন্ধন কখনই ছেড়া সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের সেই গানের ভাষায় বলতে হয়—আমি তোমারও সঙ্গে বেঁধেছি আমারও প্রাণ...। আসলেও তাই। কিরণের বাসায় গেলে দেখবেন বিতর্ক বিষয়ক ছবি, বই ছাড়া আর কিছু নেই। চারিদিকে অসংখ্য বিতর্কের ট্রফি, শুভেচ্ছা স্মারক, সম্মাননা, মেডেল অথবা আরও সব দেশি-বিদেশি সুভেনির। কিরণ বলেন, 'বিতর্ক বরাবরই যেকোনো বিষয়কে গভীরভাবে আত্মস্থ এবং বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণের একটা উপকরণ। বিতর্ক মানুষের ভাবনা বা চিন্তার জগতকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অনেক বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের কথা শুনছি। গণমাধ্যমগুলোও মতো প্রকাশ করছে। কিন্তু বিতর্কের চর্চামূলক অনুষ্ঠানে আমরা কিন্তু নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের চিন্তাভাবনার কথা শুনতে পাচ্ছি। পরিবর্তিত ধারায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো বুঝতে পারছি। বিতর্ক অনুষ্ঠান হলো—তরুণ সমাজের মতামত দেওয়ার সবচেয়ে ভালো একটা প্লাটফর্ম। কিরণ আরও বলেন, 'নিজের একটা বিশ্বাস, বোধ আর অফুরন্ত ভালোবাসা থেকেই গত দু দশক ধরে বিতর্ক চর্চার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছি। সেই বিশ্বাস কিছু নয়, যুক্তিশীল আলোকিত তারুণ্য গড়ে তোলার নির্ভেজাল বিশ্বাস। আমরা যদি কিছু আলোকিত যুক্তিশীল তরুণ গড়ে তুলতে পারি তাহলে তারাই হবে আগামীতে সমাজ বদলের রূপকার। দেশ ও দশের জন্য তারাই হবে শ্রেষ্ঠ মানুষ। আমরা সেই মানুষ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।'

- See more at: http://archive.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDRfMjlfMTNfNF8zOF8xXzM2ODky#sthash.f1yZ8TQ8.dpuf